শুক্রবার ● ১৯ জুন ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » করোনা- ‘সাম্যবাদী’ ভাইরাসের শ্রেণী পক্ষপাত ও বাছবিচার
করোনা- ‘সাম্যবাদী’ ভাইরাসের শ্রেণী পক্ষপাত ও বাছবিচার
সাইফুল হক :: করোনা ভাইরাসকে খানিকটা রসিকতা করে ‘সাম্যবাদী’ চরিত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রূপে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। কারণ এই ভাইরাস ধনী, দরিদ্র, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে সংক্রমিত করছে। আপাতদৃষ্টিতে কোভিড- ১৯ নামক এই ভাইরাসের সংক্রমনের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন বাছবিচার নেই। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশ থেকে যেসব উদ্বেগজনক তথ্য ও অভিজ্ঞতা বেরিয়ে এসেছে তাতে এই ভাইরাসের সমতাধর্মী বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে আর জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। এই ভাইরাস ইতিমধ্যে তার শ্রেণী পক্ষপাত যেমন স্পষ্ট করে তুলছে তেমনি বর্ণবাদ, ধর্মীয় ও জাতিবিদ্বেষের মত বিদ্যমান সমাজ সভ্যতার গভীর সব অন্তর্বিরোধ, বৈপরিত্য ও সংকটকেও প্রকট করে তুলেছে, উৎকটভাবে বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও করোনা মহামারীর বিরুদ্ধে ‘ফ্রন্টলাইন ফাইটার্স’ হিসাবে যারা দায়িত্ব পালন করছেন সেই ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক-গণমাধ্যমকর্মী, পুলিমসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং কোভিড- ১৯ সংক্রমিত হয়ে দুঃখজনকভাবে মারা গেছেন অনেকে। আশঙ্কা করা যায় আগামীতে এই সংখ্যা আরো বাড়বে। ঝুঁকি জেনেও এই কঠিন দুঃসময়ে সামনে থেকেই করোনা যুদ্ধে যারা যুক্ত আছেন এবং পেশাগত দায়িত্ব ও মানবিকবোধ থেকে যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করছেন তাদের অবদান নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয়। তাদের এই দায়িত্ব, সেবাপরায়ণতা ও আত্মউৎসর্গের কারণে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেঁচে থাকছেন, সুস্থ্য হয়ে উঠছেন, মহামারীর কালো অন্ধকার সময় পার হয়ে জীবনের নতুন পর্ব শুরু করবেন তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এর মধ্যেই বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের গত তিন মাসে গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্বেগজনক যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে তার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, করোনা সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে শ্রমজীবী, মেহনতি মানুষ তথা স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষের সংখ্যাই এককভাবে সবচেয়ে বেশী। বাংলাদেশে এটা নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোন জরীপ ও গবেষণা এখনও পর্যন্ত সম্পন্ন না হলেও সামাজিক গণমাধ্যমসহ বিভন্ন মিডিয়া ও সরকারি সংস্থা থেকে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে তাতে সমাজের এই অংশের মানুষের সংক্রমিত হবার গ্রাফটা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে চলেছে।
বাংলাদেশে প্রথমদিকে ইতালীসহ বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের মধ্যে সংক্রমনের হার তুলনামূলকভাবে বেশী দেখা গেলেও এখন নিম্নআয়ের শ্রমজীবী- মেহনতিদের মধ্যে সংক্রমণের মাত্রা তুলনামূলক ভাবে বেশী দেখা যাচ্ছে। মনে করা হচ্ছে করোনা ঝুঁকিতে তারাই এগিয়ে। গাজীপুর, নারায়নগঞ্জসহ ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চল, বিশেষ করে গার্মেন্টস কারখানা খুলে দেবার পর এসব অঞ্চলে অল্পদিনের মধ্যেই করোনা সংক্রমনের বিস্তার ঘটেছে। সংক্রমিতদের অধিকাংশই শ্রমিক, মেহনতি ও নিম্নআয়ের মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানেও করোনা আক্রান্তদের মধ্যে এককভাবে বড় অংশ হচ্ছে শ্রমজীবী- মেহনতি মানুষ।
শ্র্রমজীবীদের ইমিউনিটিি শক্তি বেশী এমন একটা প্রচারনা থাকলেও এটা স্পষ্ট যে, দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও অতিনিম্নমানের জীবনযাত্রার কারণে শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউনিটি) দুর্বল ও ভঙ্গুর থাকার কারণে তাদের সংক্রমিত হবার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশী এবং এই পর্যন্ত বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাও মোটামুটি একইরকম। ঘনবসতি, অস্বাস্থ্যকর জীবন, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠির মধ্যে কোভিড- ১৯ এর সংক্রমন বৃদ্ধি করে চলেছে। এই শ্রেণীর জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ এরকম দেশগুলোতে খুবই কম। গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলতে কার্যকরি কোন কিছুই এসব দেশগুলোতে এখনও গড়ে ওঠেনি। ফলে এমনিতেই যেকোন রোগব্যধিতে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই বললে চলে, যেটুকু চিকিৎসা রয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই তা নামেমাত্র। করোনার চিকিৎসা জটিল, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হওয়ায় মেহনতি গরীবদের অবস্থান এখানে একেবারেই প্রান্তিক পর্যায়ে। এটা উল্লেখ করতে দ্বিধা নেই যে, তাদের অনেকের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বে থাকা চিকিৎসাসেবীদের মনোযোগও তুলনামূলক ভাবে কম। শিক্ষার মত চিকিৎসা ব্যবস্থাও পুরোপুরি মুনাফাকেন্দ্রীক বাণিজ্যিক হয়ে যাওয়ায় করোনা মহামারী শ্রমজীবী প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে আরো বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। করোনা সংক্রমন এড়িয়ে চলতে ঘরে থাকাকে যখন প্রধান নিদান হিসাবে গণ্য করা হচ্ছে, তখন এই মেহনতি, দিনমজুর আর প্রান্তিক কোটি কোটি মানুষের ঘরে তাকার অবকাশ কোথায়!
ঝড়-বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আবার দুর্ভিক্ষ-যুদ্ধ-সংঘর্ষের মত মানবসৃষ্ট সংকট-সহিংসতার মত মহামারিতেও সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয় এই সাধারণ মানুষ। তারাই বেশী প্রাণ হারান। তারাই দলে দলে মরতে মরতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন।
আসল সংকটটা কোথায়- দারিদ্র্যে, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবের মধ্যে এবং সর্বোপরি চরম শোষণ, বঞ্চনা ও গভীর অসাম্যের মধ্যে বিদ্যমান পুঁজিতান্ত্রিক কথিত ‘নয়া উদারবাদী’ ব্যবস্থা এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে অনেকটা স্থায়ীভাবে বেকার, ভবঘুরে, গৃহহীন, রুগ্ন, শীর্ণকায় ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফেলে রাখে। স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধের জৈব ক্ষমতার বলে কেউ যদি করোনা মহামারীর মত দুর্যোগ প্রতিরোধ করে টিকে থাকে ভাল। আর বাকি একটা অংশকে জীবনের উপর অধিকার না থাকায় মৃত্যুকেই বরণ করে নিতে হয়; এবং অবহেলা ও অপরাধজনীত এই মৃত্যুকেই স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ধরনের মৃত্যুকে ‘স্বাভাবিক’ হিসাবে মেনে নেবার জন্য বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা মতাদর্শীক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাতাবরণও তৈরী করে রাখে; যাতে এই ধরনের অপমৃত্যুর পিছনের আসল সত্যটকে লুকিয়ে রাখা যায়।
করোনা মহামারী নির্মম অসাম্য ও অমানবিক চরম দারিদ্র্যের মৌলিক প্রশ্নসমূহকে যেমন আরো নগ্ন করে তুলেছে তেমনি এই মহামারী আরো একবার বর্ণবাদ, ধর্মীয় বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিবিদ্বেষকেও উৎকটভাবে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। করোনা মহামারী অভিবাসী শ্রমিক, যারা আইনগতভাবে বিভিন্ন দেশের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থার বাইরে তাদের দুর্দশা চরমে নিয়ে গেছে। যৌনকর্মী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরাও আরো একবার এই মহামারীতে চরম বৈষম্য ও হেনস্থার শিকার হয়েছেন। কেবল পেশা ও দৈহিক গঠনের কারণেই করোনা সংক্রমনের চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাদেরকে অবহেলা, বিদ্রুপ ও অসহযোগিতার কবলে পড়তে হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা দুর্যোগের শুরুতে পুরানো বর্ণবাদ, জাতিবিদ্বেষ ও সাধারণ নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে বিভেদ- বৈষম্য আবার সংকট হিসেবে উঠে এসেছে; প্রকাশ হয়ে পড়েছে অশ্বেতাঙ্গ বিশাল জনগোষ্ঠির দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র। মাথাচাড়া দিয়েছে অসহিষ্ণুতা ও ঘৃণার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। করোনা চিকিৎসায় কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয়রা যে বৈষম্যের শিকার অনেকগুলো জরীপ ও গণমাধ্যমে তা প্রকাশ পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ শতাংশ অ্যা ফ্র্রো আমেরিকানদের মধ্যে করোনা সংক্রমনের দিক থেকে এরা প্রায় ৫০ শতাংশ। শিকাগোতে এরা ৩০ শতাংশ হলেও করোনায় মৃত্যুর দিক থেকে শ্বেতাঙ্গের তুলনায় এদের হার ৬ শতাংশ বেশী। যুক্তরাজ্যে এরা ১৫ শতাংশ। কিন্তু শেতাঙ্গদের তুলনায় মৃত্যুঝুঁকি এদের চার গুণ বেশী। খোদ লন্ডনেই সংক্রমন ও মৃত্যুর দিক থেকে ৪০ শতাংশই কৃষাঙ্গই আফ্রো বৃটিশ। যুক্তরাজ্যেও ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ এশীয়রা তুলনামূলকভাবে অধিক ঝুঁকিতে। ফ্রান্স ও ইতালীর মত দেশসমূহে এই বর্ণগত, ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ প্রকট না হলেও মহামারীকালে তার এরকম নানা অভিপ্রকাশ রয়েছে।
আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতে করোনাকেন্দ্রীক মুসলমান বিদ্বেষ, হিংসা ও ঘৃণা উগ্র সাম্প্রদায়িক চেহারা নিয়েছে। দিল্লীতে তাবলীগ জামায়াতের ১৫০০ মুসল্লীদের সমাবেশ ও পরবর্তীতে দিল্লীসহ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এদের ক’জনের করোনা সংক্রমনের খবর প্রকাশিত হলে এটাকে কেন্দ্র করে দিল্লীর বিজেপি দলীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের নেতৃত্বে মুসলমানবিরোধী প্রপাগান্ডা চরমে নিয়ে যাওয়া হয়। মামলা রুজু করা হয় তাবলীগ জামায়াতের প্রধান মওলানার বিরুদ্ধে। করোনা ভাইরাসকে ‘তাবলিগ ভাইরাস’সহ নানা অভিধায় আখ্যায়িত করে মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক প্রচারণায় নতুন মাত্রা যুক্ত করা হয়; হেনস্তার শিকার হতে হয় মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেককে। আমদানি করা হয় ‘প্রডিউসার আর ডিস্ট্রিবিউটর’ তত্ত্বকে; অর্থাৎ চীন এই ভাইরাসের উৎপাদক, আর ভারতের মুসলমানেরা এর বিতরণকারি ইত্যাকার ঘৃণা আর বিদ্বেষজনক প্রচারণা। দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল আর রাজ্য সরকারও পরোক্ষভাবে এসব প্রচারণায় ইন্ধন জুগিয়েছে। করোনাকালে দুনিয়ার দেশে দেশে এই ধরনের ধর্মীয়, ঘৃণা, জাতিবিদ্বেষ ও বর্ণবাদী ‘বহুবিচিত্র’ প্রচারণা ও তৎপরতাও নতুন মাত্রা নিয়েছে।
করোনা ভাইরাস যে ক্ষুধা আর অপুষ্টিতে ভোগা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে দারিদ্র্য পীড়িত জনগোষ্ঠির দেহে সহজেই বাসা বেঁধে তাদেরকে অধিকহারে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে তা এখন আর লুকানোর কোন বিষয় নয়। এই ভাইরাস বিদ্যমান কথিত সভ্যতা আর উন্নয়নের গভীর ক্ষত, বৈষম্য আর বঞ্চনা, সমাজের গভীর অসুখ আর জরাগ্রস্ততাকে যেভাবে প্রতিদিন উদ্যোম করে দিচ্ছে তা রীতিমত অভিনব। এ কারণে সভ্যতার আদুল দেহের এই লজ্জা নিবারণে পুরো ব্যবস্থা পরিবর্তনের আবশ্যিকতাকে প্রতিদিন সামনে তুলে ধরছে।
নিউ ইস্কাটন, ঢাকা, মে ২৩, ২০২০
লেখক: সাইফুল হক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি