সোমবার ● ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » ছবিঘর » অতিমারীতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা - জরুরী কিছু বিষয়
অতিমারীতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা - জরুরী কিছু বিষয়
সাইফুল হক :: এ মুহূর্তে আপাত এক স্বস্তির খবর এই যে অনেক প্রতীক্ষার পর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলারও উদ্যোগ - আয়োজন চলছে। আশা করা যায় অক্টোবর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চালু হবে।শংকা নিয়েই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে সন্দেহ নেই।যুক্তরাজ্য - যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু কিছু দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর করোনা সংক্রমণ কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে নতুন বিপত্তি দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের কিভাবে টিকাদান কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা যায় তা নিয়েও গবেষণা ও পরীক্ষা - নিরীক্ষা চলছে।বোঝা যায় অচিরেই শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর আমাদের এখানে সংক্রমণের পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে সে ব্যাপারে এখুনি নিশ্চিত করে কিছু বলা না গেলেও এটা স্পষ্ট যে আমাদেরকেও বেশ একটা লম্বা সময় সংক্রমণের এই উঠা - নামার মধ্য দিয়েই যেতে হবে,সংক্রমণ যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই রাখতে হবে।এ বছরের মধ্যে ১০/১১ কোটি মানুষকে টিকা প্রদানসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ, বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও শিক্ষকদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে পাঠদান করা গেলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু রাখা কঠিন হবে না।আর অনির্দিষ্টকাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখারও অবকাশ নেই। গত দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় যে অপূরনীয় ক্ষতি ক্ষতি হয়েছে তার অভিঘাত এখনও পুরোপুরি বোঝা যাবে না।এই নেতিবাচক অভিঘাতের পুরোটা বুঝতে হয়তো পাঁচ / দশ বছরও লেগে যেতে পারে।বাস্তবে শিক্ষার্থীদের গোটা একটা প্রজন্মের জীবন থেকে প্রায় দুই বছর হারিয়ে গেছে। এই হারানো সময় কিভাবে ফিরিয়ে আনা যাবে,এই ক্ষতি কিভাবে পুষিয়ে আনা যাবে - এখন সেটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।পাঠদান পদ্ধতি,সিলেবাস ও প্রচলিত শিক্ষা কার্যক্রমে কিভাবে গুণগত রুপান্তর আনা যাবে, জরুরী ভিত্তিতে এই ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়া দরকার।
করোনার এই দূর্যোগে বড় সংকট তৈরী হয়েছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের এক উল্লেখযোগ্য অংশের ঝরে পড়ায়।ইউনেস্কো করোনার অতিমারীর কারণে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশংকা ব্যাক্ত করেছে। বাংলাদেশের এই সংখ্যা কত তা নির্দিষ্টভাবে জানতে হয়তো আরও সময় লাগবে।কিন্তু এটা নিশ্চিত যে,এই অতিমারী ও সরকারের অদূরদর্শীতায় এখানে বিপুলসংখ্যক ছাত্র - ছাত্রী ঝরে পড়েছে।গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে,করোনার এই দূর্যোগে বাল্য বিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, শিশুশ্রমও বেড়েছে।অনেককে অসময়ে,অকালে শিক্ষাজীবন চুকিয়ে দিয়ে বাধ্য হয়ে নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ও কষ্টকর পেশায় যুক্ত হতে হয়েছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জে সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কয়েকজন শিশু শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর জানা যায়।পরিবারের নিদারুন আর্থিক কষ্টের কারণে এই শিশুদেরকে কারখানায় কাজ নিতে হয়েছিল। অনুমান করা কঠিন নয় যে নানা ভাবে ঝরে পড়ার এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
ঝরে পড়া এই শিক্ষার্থীদেরকে স্কুল - কলেজে ফিরিয়ে আনা এখন এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সবার এখন এটা মনোযোগের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিৎ।
এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সরকারের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল।কিন্তু করোনার এই ১৮ মাসে এই ব্যাপারে সরকার, বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কোন মনোযোগ দেখা যায়নি। বলা হচ্ছে করোনা দূর্যোগ সামাল দিতে সরকার ইতিমধ্যে প্রায় দুই লক্ষ কোটি টাকা প্রণোদনা সহায়তা দিয়েছে। এর বড় অংশ পেয়েছে ব্যবসায়ীরা। প্রনোদোনার প্যাকেজ বরাদ্দ দেখেও রাষ্ট্র আর সরকারে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পর্কে খানিকটা অনুমান করা যায়।শিক্ষাখাত এই প্রণোদনায় পুরোপুরি উপেক্ষিত। অথচ প্রতিদিন শুনতে হয় ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড ‘। দূর্যোগকালে এই মেরুদণ্ড ঠিক রাখার ব্যবস্থা কি! প্রকৃতপ্রস্তাবে অভাবী ও স্বল্পআয়ের পরিবারসমূহের শিক্ষার্থীদের জন্য পরিকল্পিতভাবে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা গেলে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদেরকে ঝরে পড়া থেকে রক্ষা করা যেত।এটা কি খুব কঠিন কাজ ছিল, না।তাহলে এই ছাত্র - ছাত্রী ও তাদের অভাবী পরিবারসমূহ কেন প্রনোদনা সহযোগিতায় অগ্রাধিকারে এল না, কারা এই জরুরী প্রশ্নের উত্তর দেবেন, বোঝা মুসকিল।
এই অতিমারীতে হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। একারণে নতুন করে শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যাও বেড়েছে।এসব প্রতিষ্ঠান আবার চালু করা যাবে কিনা, তারা ন্যূনতম কোন আর্থিক সাহায্য পাবে কিনা তাও অনিশ্চিত। কিন্তু এসব বিষয় এখন সরকারের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে।
গতকাল জানা গেল সরকার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পাঠদান, সিলেবাস, পরীক্ষা পদ্ধতি ও বিভাগ নির্বাচন সংংক্রন্ত প্রচলিত পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে। এটাকে বহুল প্রতিক্ষিত পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।এই পদক্ষেপের ইতিবাচক দিক সম্পর্কে সম্যক জানতে- বুঝতে হয়তো আরও সময় লাগবে। কিন্তু যেটা আরও জরুরী তা হচ্ছে এই একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের শিক্ষা দর্শণ কি হবে, বাংলাদেশে কি একই সাথে পাঁচ/ ছয় পদ্ধতির শিক্ষা পদ্ধতি চলতে থাকবে,শিক্ষার সুযোগ অধিকার না হয়ে শিক্ষাও কি আর দশটা বেচাকেনার পণ্যের মত বানিজ্যিক ও মুনাফাকেন্দ্রীক পণ্য হয়ে থাকবে? জাতীয় পর্যায়ে এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলির যৌক্তিক মীমাংসা ব্যতিরেকে নতুন উদ্যোগসমূহ আখেরে বড় কোন ফল দেবে না।কারণ বিদ্যমান অসম ও বৈষম্যমূলক শিক্ষা পদ্ধতি সামাজিক অসাম্য ও বৈষম্য কেবল আরও বাড়িয়ে তুলছে।আবার অন্যদিকে সামাজিক বৈষম্যও শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য প্রকট করে তুলছে।
আর আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে বাস্তবে নৈতিক শিক্ষা সিলেবাস বলে কিছু নেই।প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রমেরও কোন বিকল্প নেই।এসকল বিষয়ে গভীর মনোনিবেশ ও অগ্রাধিকার ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসার কোন অবকাশ নেই।
নিউ ইস্কাটন
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১