সোমবার ● ১৫ জুন ২০২০
প্রথম পাতা » ছবিঘর » বিপন্ন সময়ে প্রাণ-প্রকৃতির ভাবনা
বিপন্ন সময়ে প্রাণ-প্রকৃতির ভাবনা
মোশরেকা অদিতি হক :: ১. হিরোশিমায় আমার ঘরের দরজা খুললেই দূর পাহাড়ের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। সারা বছর ধরে এ পাহাড়ের সারি মেঘের রঙের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিয়ে তার নিজের রং বদলায়। ২০১৮-এর মাঝামাঝিতে যখন জাপানের এ পশ্চিমাঞ্চলে অতিবর্ষণে ভূমিধস হলো, পাহাড়ের গায়ে চেরা চেরা দাগ হয়ে গিয়েছিল। সে সময় অনেক পাহাড়ি গাছের গোড়া মাটির টান ছিঁড়ে এখানকার এলোমেলোভাবে বিছিয়ে থাকা খরস্রোতা নদীগুলোতে ভেসে গেছে কোথায় কোথায় কে জানে! হঠাৎ হঠাৎ দেখলে মনে হতো কোনো দৈত্য এসে ভীষণ রাগে পাহাড়ের সারা শরীর আঁচড়ে দিয়েছে।
কিন্তু এ দুই বছরের ভেতরেই এখন পাহাড় পুরিয়ে নিয়েছে তার গায়ের ক্ষত। চোখ মেললেই তার কালচে সবুজ আভা ধরা দেয় সামনে। তিন মাসের বেশি সময় ধরে সারা পৃথিবীর মানুষেরা করোনাভাইরাসের ভয়ে ঘরের ভেতর থাকায় দূষণ কমেছে আশ্চর্য রকম, যা মহাকাশ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে নাসার স্যাটেলাইটে। বায়ুমন্ডল পর্যন্ত নিজেকে সারিয়ে তুলছে! প্রকৃতি নিজেকে মেরামত করার অবসর পেয়েছে, যেটা চূড়ান্ত নির্বোধ মানুষ তাকে দিতে পারেনি! প্রকৃতি চায় শুধু বিরক্ত না হতে। বাকি ব্যবস্থা সে নিজেই করে নিতে পারে! এ প্রকৃতি আমাদের মতো পরনির্ভর নয় একদম!
২. পাশের জঙ্গল থেকে প্রায়ই একটা বড়সড় বেজি এসে বাসার সামনের ময়লার ঘরটায় ঢুকত খাবারের খোঁজে। চমৎকার বাদামি চকচকে চেকনাই শরীরে খুব দুরন্ত সে। ছোট ছোট কালো পুঁতির মতো চোখে রাজ্যের সতর্কতা। রেশমি লেজটা বিপদের কোনো আশঙ্কা দেখলেই ফুলে যেত। তারপর একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিচে গিয়ে দেখি বেজিটা মরে পড়ে আছে।
কাছে গিয়ে দেখলাম গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্নই নেই। শুধু মুখ থেকে একটুখানি গড়িয়ে পড়া রক্তের ধারা রাস্তাতেও এসে পড়েছে নিথর শরীরের সঙ্গে। আরও বেশ কয়েক দিন পর্যন্ত ওই রক্তের কালচে দাগটা মাটিতে লেগে ছিল। মৌসুমি বর্ষায় তা-ও ধুয়ে গেল একদিন। মাঝখানে বেশ কয়েক মাস কেটে যাওয়ায় ভুলেই গিয়েছিলাম ওর কথা। কয়েক দিন আগে আবারও দুপুর বেলায় বাড়ির সামনে একটা হুটোপুটির আওয়াজ শুনে বারান্দায় গিয়ে দেখি একটা নতুন বেজি এসেছে। ঠিক আগেরটার মতো করে দৌড়ে দৌড়ে খাবার খুঁজছে। মনে হলো এ প্রকৃতি বড় অদ্ভুতভাবে ফিরিয়ে দেয় সবকিছু। ঘটনা, প্রাণ, শক্তি, সময় সবকিছু! তথাকথিত সভ্য এ মানুষকে শিখতে হবে। তাকে অনুভব করতে হবে প্রকৃতির অন্তরের বার্তা।
৩. বিশ্বজগৎ একমাত্র ভারসাম্য বোঝে। শুধুই বোঝে পরিমিতি। মানুষ কবে বুঝবে তার পরিমিতি কোথায়! প্রকৃতির কাছে তার প্রতিটি প্রাণ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ তো আলাদা কিছু নয়! মানুষ তার বুদ্ধি খাটিয়ে গোটা প্রাণ- প্রকৃতিকে রোজ রোজ শাসন-কর্ষণ-ধর্ষণ করেছে। অন্য প্রাণকে ভুগিয়েছে, এখন নিজেরাও ভুগছে। কিন্তু এই মানুষ ভোগ করা ছাড়া সরাসরি প্রকৃতির কোন উপকারে লেগেছে? যেখানে একটা সামান্য কেঁচো পর্যন্ত মাটিতে অক্সিজেন দেয়, সেখানে মানুষ তো গাছের মতো সালোকসংশ্লেষণ ও করেনা! কিসের এত গর্ব তার! পৃথিবীর বড় বড় পরিবেশবাদী দলগুলো, পরিবেশবিজ্ঞানীরা, নৃবিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই বলা শুরু করেছেন যে, মানুষ ঠিক অরণ্যের কাছে, মাটির কাছে, পৃথিবীতে অনন্য নৃগোষ্ঠীগুলোর মতো পরিবেশ রক্ষা করা জীবনব্যবস্থার কাছে যদি না ফিরে যায়; তাদের ধ্বংস ঠেকানো যাবে না। বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য এ শিক্ষা আরও জরুরি। আমরা আমাদের চরম মূল্যবান সুন্দরবন ম্যানগ্রোভকেই বাঁচাতে পারছিনা কয়লার দূষণ থেকে; উন্নয়নের থাবা থেকে। আমাদের দেশের পরিবেশবাদীরাও কিন্তু বলেছেন, এই বন রক্ষা করা সম্ভব, কেবলমাত্র তাকে আর বিরক্ত না করে!
আমাদের উন্নয়ন আমাদের দম আটকে দেয়! নব্য পুঁজিবাদী উন্নয়নের স্রেফ বমি করা শহরের বাতাসে ভাসা সিসা ক্যাডমিয়ামও আমাদের ফুসফুসে আস্তানা গাড়ে, সেখানে সরকারি অব্যবস্থাপনার ফলস্বরূপ করোনার বিস্তার তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! আমাদের এখন অতি দ্রুত ফিরতে হবে মাটির কাছে, আরও পরিবেশ বিপর্যয় এড়াতে আমূল বদলে ফেলতে হবে জীবনব্যবস্থা, অভ্যাস। প্রত্যেককে। এ যাত্রায় বেঁচে গেলে সামনে অনেক কাজ আমাদের। গাঙ্গেয় বদ্বীপ সমভূমির মানুষ বুঝতে শিখুক তার মাটির সত্য। নির্জন সমুদ্র উপকূলে খেলতে থাকা গোলাপি ডলফিনদের হত্যাকারী না হয়ে সে বরং হোক তাদের রক্ষাকর্তা। কোনো এক গভীর সন্ধ্যায় এই ‘অচিন’ মানুষ বসুক প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি ফিসফিস করে তার কানে কানে বলুক, ‘তুমি আমার পাশে বন্ধু হে বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো। ’
লেখক : মোশরেকা অদিতি হক, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত।