শনিবার ● ১৩ জুন ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আর সংগ্রামের ১৬ বছর বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ঐতিহাসিক যাত্রা
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আর সংগ্রামের ১৬ বছর বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ঐতিহাসিক যাত্রা
আবু হাসান টিপু :: আজ থেকে ১৬ বছর আগে ২০০৪ সালে ১৪ জুন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্বের চরম সুবিধাবাদী ও শাসকশ্রেণীর লেজুড়বৃত্তির অধঃপতিত রাজনৈতিক ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পার্টির বিপ্লবী সত্ত্বা ও রাজনীতি রক্ষার মহান ব্রত নিয়ে আজকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি আত্মপ্রকাশ করে।
ওয়ার্কার্স পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের প্রধান শ্লোগান ছিল, ‘আওয়ামী দুঃশাসন রুখে দাড়াঁও, বিএনপি-জামাতের সাম্প্রদায়িক ও দক্ষিনপন্থী রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচন কর’। সন্দেহাতীতভাবে এ শ্লোগানের মর্মকথা হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেন্দ্রীক দুই মেরুকরণের বাইরে বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলার প্রত্যয়। শুধু তাই নয় ‘পার্টি ও কমিউনিস্ট আন্দোলন পুনর্গঠন’ এবং লুটেরা শাসকশ্রেণীর ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত দলমূহ এবং তাদের মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলের বাইরে ‘বাম গণতান্ত্রিক বিকল্প’ গড়ে তোলাই ছিল ওয়ার্কার্স পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের গৃহীত লাইন। রীতি অনুযায়ী কংগ্রেসের গৃহীত লাইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করবেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি। অথচ কেন্দ্রীয় কমিটি কেবল সেই দায়িত্ব পালনেই চরম ব্যার্থতা ও দায়িত্বহীনতারই পরিচয় দিয়েছিলেন তাই নয়; বরং কেন্দ্রীয় কমিটির অধঃপতিত নেতৃত্ব কংগ্রেসের গৃহীত রাজনীতি ও রাজনৈতিক লাইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজেদেরকে লুটেরা ধনিকশ্রেণীর নির্লজ্জ অনুসারিতে পরিণত করেছিলেন। নেতৃত্বের এহেন কর্মকান্ডে সেদিন কেবল ওয়ার্কার্স পার্টিই বিপর্যস্ত হয়নি, তৎকালীন বাম ফ্রন্ট ও ১১ দলসহ দেশের গোটা বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনও বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়। কয়েক দশকের অর্জন চলে যায় শাসকশ্রেণীর ঝুড়িতে। সুবিধাবাদীতা ও ডিগবাজীর এরকম নজির আজও বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।
তৎকালীন পার্টির ঘোষণা-কর্মসূচি-গঠনতন্ত্রে এবং পার্টির কংগ্রেসের দলিলে বিপ্লবী মতাদর্শ, রাজনীতি ও সংগঠন গড়ে তোলার যে কর্তব্য ঠিক করা হয়েছিল পার্টির দৈনন্দিন কর্মকান্ডে তা হয়ে উঠেছিল উপেক্ষিত। এমনকি পার্টিতে মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক অধঃপতন এবং ক্রমান্বয়ে পার্টিকে একটি পাতিবুর্জোয়া দলে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে পার্টির অভ্যন্তরে আন্ত পার্টি সংগ্রামের চেষ্টা চললেও অধঃপতিতরা এক পর্যায়ে বিপ্লবী রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশটা যেমন নষ্ট করে, তেমনি পার্টির অভ্যন্তরে সাধারণ গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগও পুরোপুরি রুদ্ধ করে দেয়। ফলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে আন্ত পার্টি সংগ্রাম। শ্রমিকশ্রেণীর মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজ পরিবর্তনের লক্ক্ষ সংগ্রামী সচেতন উদ্যোগের পরিবর্তে অধঃপতিতরা মার্কসবাদ লেনিনবাদকে ব্যাক্তিগত জীবনের সুযোগ সুবিধার পাথেয় হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হন। ফলে তাদের মধ্যে দিন দিন দায়িত্ববোধ, প্রয়োজনীয় ঝুকি নেয়া ও পার্টির পরিকল্পিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিবর্তে একদিকে পদ পদবী টিকিয়ে রাখার সস্তা প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে নিজেকে পার্টির সর্বেসর্বা প্রতিয়মান করতে ব্যাক্তি প্রচারে লিপ্ত হয়ে পরেন। ফলস্বরূপ পার্টি কার্যত সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক চরিত্রের একটি ঢিলেঢালা দলে পরিণত হয়ে পরে। যে কারণেই পার্টি ও পার্টির নেতৃত্বের মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক অধঃপতন ঠেকিয়ে পার্টির নিবেদিত প্রাণ নেতা কর্মীদের বিপ্লবী সত্ত্বা ও রাজনীতি রক্ষার ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাধে তুলে নেয়ার অনিবার্যতা সৃষ্টি হয়। এবং এই বাধ্যবাধকতার কারণেই প্রকাশ্যে মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহন করা ছাড়া পার্টির সৎ ও আদর্শবান নেতা কর্মীদের আর কোন পথ খোলা থাকেনা।
সুবিধাবাদীতা ও শাসকশ্রেণীর লেজুড়বৃত্তির অধঃপতিত রাজনৈতিক ধারার বিরুদ্ধে দাড়িয়ে কমরেড সাইফুল হক ও কমরেড খন্দকার আলী আব্বাস এর নেতৃত্বে ২০০৪ সালে ১৪ জুন তৎকালীন ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় ৫ নেতা পার্টি পুনর্গঠনের যাত্রা শুরু করেন। নেতৃবৃন্দের প্রাণনাশের হুমকি,রুচিহীন অপপ্রচার, চরিত্র হনন, হয়রানী শারীরিক আক্রমণ ও সীমাহীন প্রতিকুলতা মোকাবেলা করেই প্রথমে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠন) পরে ২০০৮ সালে আজকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নামে আত্মপ্রকাশ করে।
২০০৪ এর জুন থেকে দল পুনর্গঠনের উদ্যোগের পাশাপাশি পার্টি তৎকালীন বিএনপি জামাত জোটের দঃশাসনের বিরুদ্ধে ও সেনা মদদে পরিচালিত ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনের অবৈধ ও অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধেও রাজপথে গণসংগ্রামে পার্টি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ওই সময়কালে প্রথমে গণমুক্তি আন্দোলন ও পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা গঠন এবং এর নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামেও পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২০০৭-এ ১/১১ এর মধ্যো দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনা কর্তৃত্বে পরিচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকাররের হাত ধরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাদের সীমাহীন দুর্নীতি, সর্ব ক্ষেত্রে লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার, পরিকল্পিত ভাবে শেয়ার বাজার ধ্বংস, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক লুটপাটকে জায়েজ করা, নির্বাচন কমিশনকে দলীয় সংস্থায় পরিণত করা, বীনা ভোটে সরকার পরিচালনা করা, বেসুমার ভোট ডাকাতিকে ভোটের সুনামী বলে দম্ভোক্তি করা, বিরোধী দল মতের উপর দমন পীড়ণ, বিনা বিচারে হত্য, খুন, গুম, জেল জুলুম ও এক ব্যাক্তির ভয়ানক কতৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার করলে শ্রেণী পেশার আন্দোলনসহ গণতান্ত্রিক অধিকার, শ্রেণী ও জাতীয় প্রশ্ন এবং বিভিন্ন ইস্যুতে গড়ে উঠা আন্দোলনকে সমন্বিত ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়ার আবশ্যকতা তৈরী হয়। ফলস্বরূপ পার্টির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাম মোর্চাকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলা হয় বাম গণতান্ত্রিক জোট। এই জোট তার লক্ষ্য পুরণে অবিচল থাকলেও দীর্ঘদিন ধরেই শরিকদের কারো কারো দোদুল্যমানতা ও পিছু টানের কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী আওয়ামী ফ্যাসীবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে এগুতে পারছেনা। এই চরম প্রতিকুলতার মধ্যেও পার্টি ও আন্দোলনকে পুনর্গঠন করার কাজে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এখনও বদ্ধপরিকর।
তৎকালীন ধারাবাহিক মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের পরিণতিতে ওয়ার্কার্স পার্টির লেজুড়বৃত্তির সুবিধাবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ২০০৪ এর ১৪ জুন পার্টির বিপ্লবী রাজনীতি ও বিপ্লবী সত্তা রক্ষায় পার্টি পুনর্গঠনের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল গত ১৬ বছরে সীমাহীন প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে পার্টির মতাদর্শিক, রাজনৈতিক ও সংগঠনগত দিক থেকে তার এই ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক অবস্থান গ্রহনের যৌক্তিকতা, তাৎপর্য ও গুরুত্ব ইতোমধ্যে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করেছে। সুবিধাবাদীরা মৌলবাদ বিরোধী সংগ্রামের কথা বলে কিভাবে আওয়ামী লীগের নিকৃস্ট লেজুড়ে পরিণত হয়েছে, কিভাবে বাম ফ্রন্ট ও ১১ দলকে ছত্রভঙ্গ করে আওয়ামী লীগের সাথে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের লক্ষ্যে কথিত ২৩ দফার ভিত্তিতে প্রথমে ১৪ দলীয় জোট ও পরবর্তীতে স্বৈরতন্ত্রী এরশাদের জাতীয় পার্টি ও মৌলবাদী খেলাফত মজলিশসহ শাসকশ্রেণীর যাবতীয় জঞ্জালের সঙ্গে থেকে ক্ষমতার ছিটেফোটা বখরা পাওয়ার মোহে মহাজোটে সামিল হয়ে নৌকায় উঠে পড়েছে তা সবার জানা। কিভাবে তারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সঙ্গি হয়েছে, কিভাবে ২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারীর ভোটার বিহীন নির্বাচনে অংশিদার হয়েছে, কিভাবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগের দিন রাতে ভোট ডাকাতিতে সামীল হয়ে বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গৌরবোজ্জল ঐতিহ্যে কালিমা লেপন করেছে সচেতন মানুষের তা কোনভাবেই ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
দেশের বামপন্থী আন্দোলনে অন্তর্ঘাতমূলক বিলোপবাদী এসব নানা প্রবণতা ও ধারার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পার্টি ও বিপ্লবী বামপন্থী আন্দোলন পুনর্গঠন ও বিকশিত করার কাজকে এগিয়ে নিতে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ইতোমধ্যেই বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বাতিঘর হিসাবে দেশবাসীর নিকট প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণীত হয়েছে। বিগত ১৬ বছর পার্টি তার বহুবিধ ভূমিকার মধ্যো দিয়ে মতাদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে নিজের অবস্থান গ্রহনের ন্যায্যতা এবং তাৎপর্য যেমন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে , আগামীতে আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে বিদ্যমান চরম অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই যেমন বেগবান করবে তেমনি বিপ্লবী আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও পার্টি তার অঙ্গীকার পুনব্যাক্ত করছে।
লেখক : আবু হাসান টিপ, রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ।