মঙ্গলবার ● ১৩ এপ্রিল ২০২১
প্রথম পাতা » ছবিঘর » বিপ্লবী নেত্রী বহ্নিশিখা জামালী সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবনী
বিপ্লবী নেত্রী বহ্নিশিখা জামালী সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবনী
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য দেশের বিশিষ্ট নারীনেত্রী বহ্নিশিখা জামালীর জন্ম ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মীর্জাপুর গ্রামে। তিনি তার পিতা মোদাচ্ছের হোসেন জামালী ও মাতা কল্পনা জামালীর বড় সন্তান। তারা ছয় ভাইবোন।
শৈলকুপার বেনিপুর হাইস্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাশ করেন। আর খুলনার বয়রা মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। খুলনায় দৌলতপুর বিএল কলেজ থেকে স্নাতক, আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। খুলনা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রী অর্জন করেন।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক তার জীবনসাথী। তাদের কন্যা ড: মোশরেকা অদিতি হক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
বহ্নিশিখা জামালীর রাজনৈতিক শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ তার পরিবারে। বিশেষত: তার বাবার কাছে। তার বাবা ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী, চিন্তাশীল ও সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ। প্রথম জীবনে তিনি বাম প্রগতিশীল আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন। আর তার মায়ের পরিবার ছিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। বাবা-মার এই যুগলবন্দিতে আধুনিক, সংস্কারমুক্ত ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আবহের মধ্যেই বহ্নিশিখা জামালীর বড় হয়ে উঠা। পরিবারের বড় সন্তান হিসাবে বহ্নিশিখা জামালীকে অনেক প্রতিকুল অবস্থা মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু আদর্শবাদী বাবার কারণে এই পরিবারকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
দেশের মুক্তিযুদ্ধেও এই পরিবারের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তার চাচা মাহবুব হোসেন জামালী (কালু কমান্ডার) ঝিনাইদহ-শৈলকুপা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জল ভূমিকা পালন করেন। তার বাবাও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৯৭১এ চাচার কাছ থেকে তিনি গ্রেনেড নিক্ষেপের কৌশলসহ কিছু প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন।
মায়ের ধারাবাহিকতায় বহ্নিশিখা জামালী তাদের পরিবারে আবার সঙ্গীতচর্চা নিয়ে এসেছেন। খুলনা বেতারে ক’দিন তিনি গানও গেয়েছিলেন। পারিবারিক এই পরিবেশেই তার ভাই-বোন সবাই সঙ্গীত ও সংস্কৃতিতে ভূমিকা রেখে চলেছেন।
১৯৭৭ সালে সাইফুল হক এর সাথে পরিচয়ের পর থেকে ছাত্র রাজনীতিতে ক্রমে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বহ্নিশিখা জামালী ন্যাপ এর সাথে রাজনৈতিকভাবে সম্পর্কিত জাতীয় ছাত্রদলে বিএল কলেজে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৯ সালে এই জাতীয় ছাত্রদল থেকেই তিনি খুলনার বিএল কলেজ ছাত্র সংসদে “শিখা-তাপস” পরিষদে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ঐতিহ্যবাহী বিএল কলেজের ইতিহাসে এই প্রথম কোন নারী ভিপি পদে নির্বাচন করেন। খুলনায় এই নির্বাচন তখন যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। পরবর্তীতে তিনি খুলনায় ছাত্র ঐক্য ফোরাম ও ‘সংগঠক’ গ্রুপের খুলনা ইউনিটের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই সময় তিনি খুলনা, দৌলতপুর, মহেশ্বরপাশা ও আডংঘাটায় কয়েকটি পাঠকচক্রের সাথেও সম্পর্কিত ছিলেন।
১৯৮৩ সালে স্থায়ীভাবে ঢাকায় আসার পর প্রথমে মজদুর পার্টি ও পরবর্তীতে ঐক্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং পার্টির ঢাকা মহানগর কমিটির অধীনে সংগঠিত হন। ১৯৮৬-৮৭ সাল থেকে নারী মুক্তি সংসদের সাথে তার সাংগঠনিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সময় সাপ্তাহিক নতুন কথায় তিনি লিখতে শুরু করেন। নারীশ্রমসহ নারীমুক্তির নানা বিষয় ছিল তার লেখার মূল উপজীব্য।
পারিবারিক প্রয়োজনে প্রথম দিকে তাকে স্কুল-কলেজ ও পরবর্তীতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা “নিজেরা করি”তে চাকুরী নিতে হয়। ১৯৯৭ সালে তিনি চাকুরী ছেড়ে দেন এবং গ্রামীণ ট্রাস্টসহ কয়েকটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে গবেষণাধর্মী কাজে যুক্ত হন। ১৯৯৭ সাল থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগঠনে তিনি আরো সক্রিয় হয়ে উঠেন; নারী অধিকার ও নারী মুক্তি আন্দোলনেও তিনি আরো তৎপর হয়ে ওঠেন। ২০০১ এ শ্রমজীবী নারীদের জাতীয় সম্মেলনে শ্রমজীবী নারী মৈত্রী গঠিত হলে তিনি এই সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক পদে নির্বাচিত হন। গত ছয় বছর ধরে তিনি এই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
২০০৪ সালে ওয়ার্কার্স পার্টির অভ্যন্তরে মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে পার্টির প্রধান নেতৃত্বের লেজুড়বৃত্তির সুবিধাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সাইফুল হকসহ পার্টির কেন্দ্রীয় পাঁচ নেতা আলাদা অবস্থান গ্রহণ করলে এবং পার্টিকে মতাদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে পুনগঠনের ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞ শুরু করলে তিনি এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন এবং পর্যায়ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রথমে তিনি কেন্দ্রীয় পুনর্গঠন কমিটির সদস্য হন এবং ২০০৫ এ পার্টির ৭ম কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির অষ্টম কংগ্রেসের পর তিনি সভাপতিমন্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০১৭ সালে পার্টির নবম কংগ্রেসের মাধ্যমে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাজনৈতিক পরিষদের সদস্যও নির্বাচিত হন।
এরশাদ সামরিক স্বৈরতন্ত্রবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ’৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন, তেল-গ্যাস-জাতীয় সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আন্দোলন, এই কমিটির নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত লংমার্চ-রোডমার্চ, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন, বামফ্রন্ট, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, বাম জোটসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সংযুক্ত মোর্চার আন্দোলনের নানা কর্মসূচীতেও তিনি সক্রিয় ও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন; বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তেল-গ্যাস-জাতীয় সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির হরতালে সপরিবারে গ্রেফতার হয়ে হাজতবাসও করেছেন। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার বিক্ষোভের কর্মসূচীতে পুলিশের ছোড়া টিয়ারগ্যাসের শেলে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। গত তিন দশকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচীতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছেন।
বহ্নিশিখা জামালী ’৮০ এর দশক থেকে লেখালেখির সাথে যুক্ত। সাপ্তাহিক নতুন কথা, আজকের কাগজ, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক সমকাল, মাসিক জনগণতন্ত্র, পাক্ষিক কালের দাবি পত্রিকায় তিনি অসংখ্য নিবন্ধ ও কলাম লিখেছেন। তিনি মাসিক জনগণতন্ত্র ও পাক্ষিক কালের দাবি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার দু’টি গ্রন্থ ‘ইউরোপে সাতাশ দিন’, ‘নারী, প্রকৃতি প্রাণবৈচিত্র ও আমাদের বিপন্ন অস্তিত্ব’ প্রকাশিত হয়েছে। তার আরো দু’টি বই এখন প্রকাশের অপেক্ষায়। তার লেখার প্রধান উপজীব্য নারী অধিকার- নারী মুক্তি, প্রাণ-প্রকৃতি-জীববৈচিত্র্য ও সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়াদি।
তিনি ভারত, নেপাল, ফ্রান্স, জার্মানী, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড ও জাপান সফর করেছেন। প্রথমার ইউরোপ সফরে তিনি সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিক ক্যারাভানে অংশ নিয়েছেন। দ্বিতীয়বারের ইউরোপ সফরে তিনি নারী মুক্তি বিষয়ক কয়েকটি আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে ওয়ার্কার্স পার্টি ও শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
বহ্নিশিখা জামালীর রক্ত-মজ্জায় সঙ্গীত। কিন্তু গলার সমস্যার কারণে তার সঙ্গীত সাধনা বারবার হোচট খেয়েছে। তিনি কবিতা পড়তে ও লিখতে পছন্দ করেন। অবসরে ছবি আঁকার চেষ্টাও তার আগ্রহের বিষয়। আর ছাদবাগান তার প্রিয় বিষয়। সময় পেলে তিনি ছাদবাগানের পরিচর্যা করতেও ভালবাসেন।
১৩ এপ্রিল, ২০২১।