বৃহস্পতিবার ● ২৩ জুলাই ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » মহামারী দুর্যোগ-অবারিত দুর্নীতির দায় কার ?
মহামারী দুর্যোগ-অবারিত দুর্নীতির দায় কার ?
সাইফুল হক :: করোনা মহামারীর দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি চুরি আর দুর্নীতির অনেকগুলো রাস্তা আরো উন্মুক্ত করে দিয়েছে। কিছু ব্যক্তি ও তাদের সিন্ডিকেটসমূহ মহামারীর এই দুর্যোগকে বিরাট সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং রাতারাতি প্রতারণা, চুরি, দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে বেশুমার অর্থবিত্ত গড়ে তুলছে। অতীতেও নানা মহামারী বা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ব্যবহার করে একশ্রেণীর মানুষ জালিয়াতি, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও অর্থসম্পদ আত্মসাতের মধ্য দিয়ে দ্রুত বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছে। মহামারী-দুর্যোগ ধনে-প্রাণে লক্ষ লক্ষ, কখনও কোটি কোটি মানুষকে নিঃস্ব-রিক্ত অবস্থায় মৃত্যুমুখে ঠেলে দিলেও, অনেক গ্রাম, জনপদ, মানববসতি উজাড় করে ফেললেও এর মধ্য দিয়ে আবার আমাদের এই অঞ্চলসহ পৃথিবীর দেশে দেশে মুনাফাখোর নতুন এক শ্রেণীও গড়ে তুলেছে। মহামারী বা দুর্যোগোত্তর সময়ে শ্রেণীবিভাজন নতুন চেহারা ও বৈশিষ্ট্য নিয়েছে। এসব তৎপরতা শাসকগোষ্ঠির নজরের বাইরে ছিল না; বরং অনেক ক্ষেত্রে শাসককুলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদেই এসব অপতৎপরতা সংঘটিত হয়েছে। আমাদের এখানকার অভিজ্ঞতাও এরকমই।
এখন এসব অপকর্ম-অপতৎপরতা আরো খোলামেলা, আরো প্রকাশ্য। একবার ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে পড়তে পারলে এখানে যা খুশী তাই করা যায়। পুরো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গিলে খেয়ে ফেললেও পার পেয়ে যাওয়া যায়। সবকিছু হজম করে নেয়া যায়। রাষ্ট্রক্ষমতা এখন শাসকগোষ্ঠি ও তাদের ছত্রছায়ায় থাকা একশ্রেণীর মানুষের জন্য দ্রুত অর্থবিত্ত গড়ে তোলার প্রধান বাহনে পরিণত হয়েছে। নিজেদের সুবিধা ও সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রের মধ্যে তারা আবার নানা ছোট ছাট রাষ্ট্র গড়ে তোলে। কখনও কখনও এখানে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলে কেউ কেউ ছিটকে পড়ে। তখন এদের দৌরাত্ম আর চুরি-দুর্নীতি-প্রতারণার অবিশ্বাস্য কাহিনীর কিছুটা মানুষ জানতে পারে। কিছুদিন এসব নিয়ে হরেক রকম ‘গসিপ’ চলে। আমাদের রাজনীতিমনস্ক মানুষ কতভাবেই না রাজা-উজির মারে; হতাশা-নৈরাজ্য আর ক্ষোভ-বিক্ষোভও প্রকাশ করে। রাষ্ট্র প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখনও কখনও এদেরক গ্রেফতার করে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হেফাজতে রাখে, মামলা ঠোকে। একসময় এদের অধিকাংশই বেরিয়ে আসে। পুরো প্রক্রিয়ায় অবৈধ ও অনুপার্জিত আয়ের যে অংশ খরচ হয় তার থেকে শতগুণ অর্থসম্পদ সুরক্ষিতই থেকে যায়। ক্ষমতার সিণ্ডিকেটসমূহ বহাল-তবিয়তেই থাকে।
প্রতারক ও জালিয়াত সাহেদ তার রিজেন্ট হাসপাতালে ভুয়া করোনা সার্টিফিকেট প্রদান ও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অসংখ্য অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে ।সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালে র্যাবের অভিযান এর পর পালিয়ে থেকে স্ত্রীকে সাহেদ জানিয়েছে- যেখানে আছি নিরাপদেই আছি। প্রায় চার দশক আগে কুখ্যাত সন্তাসী ইমদু গ্রেফতার হয়েছিল তৎকালীন বিএনপি সরকারের যুব বিষয়ক মন্ত্রী আবুল কাশেমের বাড়ী থেকে। ইমদুর মত সাহেদ এর নিরাপদ আশ্রয় কোথায় ছিল জনমনে এই নিয়ে বহু প্রশ্ন ও কৌতুহল রয়েছে।
আটক হবার পর সাহেদ দম্ভ প্রকাশ করে বলেছে ছয় মাসের বেশী তাকে আটকিয়ে রাখা যাবে না, তারপর সে সবাইকে দেখে নেবে। অনুমান করা যায় রিম্যান্ড শেষ হবার পর সাহেদ কিছুদিন জেলে থাকবে, তারপর জিকে শামীম ও সম্রাটদের মত অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে যাবে, জামাই আদরে থাকবে ; তারপর একসময় জামিনে বেরিয়ে আসবে। কিছুদিন পর আমরা আবার একরম আরেকজনকে নিয়ে মেতে থাকব। এইভাবেই আমরা বছরের পর বছর আর দশকে পর দশক পার করছি।
করোনা মহামারী কেন্দ্র করে চুরি, দুর্নীতি, জালিয়াতি, অনিয়ম, প্রতারণা ইতিমধ্যে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ডা. সাবরিনা ও তার স্বামীর এক ল্যাপটপ থেকেই নাকি করোনা পরীক্ষার ১৫ হাজার ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়েছে। মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে ঠিকাদার মিঠুর একাই ৯০০ কোটি টাকা আত্মসাতের নানা কাহিনী প্রকাশ করে চলেছে। ২০১৪ সালের পর থেকে যে রিজেন্ট হাসপাতালের রেজিষ্ট্রেশনই নেই করোনা চিকিৎসার ‘ডেডিকেটেড হাসপাতাল’ হিসেবে সরকার কিভাবে তাদের সাথে চুক্তি করে, গত জুন মাসেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি বরাবর যখন এসব প্রতারণার অভিযোগ উত্থাপিত হয় তারপরও এসব মেগা প্রতারকদের বিরুদ্ধে যখন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না তখন নাগরিকেরা বুঝে নেয় ভদ্রবেশী প্রতারক আর জালিয়াতেরা কত যায়গা না দখল করে আছে। মাস্ক, ভুয়া অক্সিজেন সিলিণ্ডার, পালস অক্সিমিটার, স্যানিটাইজারসহ করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসা সামগ্রী নিয়ে উঠা শত শত অভিযোগের তো কার্যকরি তদন্ত ও কোন বিচার-আচারই হোল না।
করোনা পরীক্ষার সার্টিফিকেট সংক্রান্ত জালিয়াতি কোন সাধারণ অপরাধ নয়, মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন; হাজার হাজার সুস্থ্য মানুষের সংক্রমনের ঝুঁকিতে পড়ার প্রশ্ন। ক’দিন আগে ইতালীতে ফিরে যাওয়া বাংলাদেশীদের মধ্যে ৩০ জনের করোনা পজেটিভ শনাক্ত করা হয় এবং এরপর বাংলাদেশী অভিবাসী বহনকারী অপর বিমানকে ইতালীতে নামতে দেয়া হয়নি। স্বয়ং ইতালীর প্রধানমন্ত্রী এরকম বাংলাদেশীদেরকে এক একটি করোনা আক্রান্ত ‘মানববোমা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পরিহাস এই যে ইতালী থেকে ফিরে আসা যে বাংলাদেশীরা করোনা ভাইরাস বহন করে বাংলাদেশে নিয়ে এল সংক্রমনের ঝুঁকির কারণে তারাই এখন ইতালীতে নামতে পারছে না। পৃথিবীর আরো ক’টি দেশকে অনুসরণ করে ইতালীও এখন কমপক্ষে আগামী ৩ মাসের জন্য বাংলাদেশীদের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা জারী করল। করোনা পরীক্ষার এসব অবিশ্বাস্য জালিয়াতি ও প্রতারণার কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি কেবল তলানীতে যেয়ে ঠেকছে না, আগামীদিনে অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বড় ধরনের সংকটেরও মুখোমুখি হতে হবে। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারসহ নানান গুরুতর অভিযোগে সরকারদলীয় সাংসদ পাপলু এখন কুয়েতের কারাগারে। এসব ঘটনা বাংলাদেশের অভিবাসী ও অভিবাসী অর্থনীতিকেও নানাভাবে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এসব মাফিয়াদের বাড়-বাড়ন্ত সরকারসহ গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছত্রছায়াতেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাকি দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে প্রায় প্রতিদিন এর বিপরীত চিত্রই দেখতে হচ্ছে। রাষ্ট্র ও তার ক্ষমতার কাঠামোগুলো এখন অনেকটাই এই মাফিয়া-দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণে। এ কারণে এক ব্যাংক কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার হালদার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট ও পাচার করে নির্বিঘেœ বিদেশে পালিয়ে যেতে পেরেছে; ব্যাংকের এক ডিরেক্টরকে গুলি করে মেরে ফেলতে যাওয়া সিকদার গ্রুপের দুই ভাই নিজস্ব বিমানে চড়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ব্যাংককে পালিয়ে যেতে পেরেছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এই দুই জনকে দেশ ছেড়ে যেতে না দেওয়ার কোন নির্দেশনা তারা পাননি। এইভাবে রাষ্ট্র যখন খোলাখুলিভাবে দুর্বৃত্তদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় তখন নাগরিকদের দিক থেকে এই ধরনের রাষ্ট্রের উপযোগিতা নিয়ে জরুরী নানা প্রশ্ন উঠে আসা অস্বাভাবিক নয়। একটি মাত্র পরিবার যখন রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে অবৈধ পথে মাত্র এক/দেড় দশকে দেশের সাতটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক ও পাঁচটি বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিদ্যুৎ গতিতে শত শত প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে ওঠে তখন জনগণের দিক থেকে এই ‘স্বজনতুষ্টির’ উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা কি- ইত্যাকার হাজারো প্রশ্ন নানা দিক থেকেই উত্থাপিত হচ্ছে।
চিহ্নিত কিছু মাফিয়া সিণ্ডিকেটের কাছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা এখন একাকার। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকদের সাথে এরা বহুমাত্রিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। সরকারের কাছেও এরা নিজেদেরকে গুরুত্বপূর্ণ কর তুলেছে। সরকারের অস্তিত্ব ও টিকে থাকার সাথে এদের অস্তিত্ব ও টিকে থাকাও সম্পর্কিত। একারণে ক্ষমতায় থাকতে ভোটের মাধ্যমে জনসম্মতি আদায়ের চেয়ে এদের সমর্থন অনেকবেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, প্রতিষ্ঠানসহ এদের উপর সরকারের নির্ভরশীলতা যত বাড়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের রাজনৈতিক ও নৈতিক ক্ষমতাও তত কমতে থাকে। এ কারণে ক্যাসিনো কেলেংকারী, ব্যাংক, শেয়ার মার্কেট লুট, অর্থ পাচারসহ দুর্নীতি, জালিয়াতি ও প্রতারণার রোমহর্ষক ঘটনাবলী একে একে চাপা পড়ে; এক ঘটনা আরেক ঘটনাকে টপকে যায়। সম্রাট, জিকে শামীম, পাপিয়া, আর হালের সাহেদ, সাবরিনাদের যারা তৈরী করেছে, সামনে ও পিছনে থেকে যারা মদদ জুগিয়েছে, বাহবা দিয়েছে, রাতারাতি ‘টক শোতে’ বুদ্ধিজীবী বানিয়েছে তারা সবাই ধরা- ছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতে পারেন।
বস্তুত: সাহেদ, সাবরিনা-আরিফ দুর্বৃত্তায়িত গোটা ব্যবস্থার কনা মাত্র, উল্কাপাতের মত। হাজার হাজার সাহেদ-সাবরিনাদেরই এখন দৌরাত্ম। সমস্যা হয়েছে ওদের মুখোসটা খসে পড়ায়। আর যে বিপু সংখ্যক নানা তকমা নিয়ে মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের জন্য ব্যবস্থা কি ? এই নিদান এর ব্যবস্থা করতে পারলেই বোধ করি দেশ ও জনগণের মুক্তি।
১২ জুলাই ২০২০, নিউ ইস্কাটন, ঢাকা