সোমবার ● ৭ জুন ২০২১
প্রথম পাতা » অর্থবাণিজ্য » বাজেট প্রত্যাহার করুন ও জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী ঢেলে সাজান
বাজেট প্রত্যাহার করুন ও জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী ঢেলে সাজান
ঢাকা :: আজ নতুন অর্থবছরের বাজেট সম্পর্কে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ২০২১ আগামী অর্থবছরের জন্য যে জাতীয় বাজেট প্রস্তাবনা ঘোষণা করা হয়েছে তা বিত্তবান, সম্পদশালী ও ব্যবসায়ীদেরকে খুশী করলেও দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে চরমভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে। করোনা মহামারী দুর্যোগ মোকাবেলা ও তা থেকে উত্তরণে অর্থমন্ত্রীসহ সরকার ‘জীবন-জীবিকা’ রক্ষার যে বাজেট দেবার অঙ্গীকার করেছিল সে অঙ্গীকার তারা রাখেনি। এটা দেশের সাধারণ মানুষের সাথে এক ধরনের প্রতারণার সামিল। এটা স্পষ্ট যে, এটা মহামারী দুর্যোগ মোকাবেলার বাজেট নয়, দুর্যোগ উত্তরণের বাজেট তো নয়ই। এই বাজেট দিয়ে কোনভাবেই করোনা দুর্যোগজনীত বহুমাত্রিক নেতিবাচক অভিঘাত মোকাবেলা করা যাবে না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই ঐতিহাসিক বছরেও বাজেট সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেনি; বরং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিপরীতেই বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে যেয়ে বাজেটে ব্যবসায়ী ও বিত্তশালীদের আরো সুবিধা করে দেয়া হয়েছে; দারিদ্রসীমার নীচে নেমে আসা ছয় কোটি মানুষ এবং করোনা দুর্যোগের নানা অভিঘাতে বিপর্যস্ত দেশের ৬০ শতাংশ মানুষের জন্য ছিটে- ফোটা দান-খয়রাত আর দয়া দাক্ষিন্ন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ তেমন কিছু নেই। উল্টো এই বাজেটের মধ্য দিয়ে সম্পদশালীরা আরো সম্পদশালী হবে, আর এই বছরের মধ্যেই আরো পঞ্চাশ লক্ষাধিক মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নীচে নেমে আসবে।
তিনি বলেন, করোনা দুর্যোগজনীত পরিস্থিতিতে যেসব খাতে এবং নিম্নআয়ের যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাজেটের অগ্রাধিকারে থাকার কথা ছিল তা হয়নি। স্বাস্থ্য-চিকিৎসা খাত গুরুত্ব পায়নি, শিক্ষাখাতের বরাদ্দ ও মনোযোগ অপ্রতুল। উল্টো শিক্ষার ব্যয়ভার বেড়ে যাবার রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির অবস্থা তথৈবচ। রাষ্ট্রায়াত্ত্ব পাটকল, চিনিকল, সুতাকলসহ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় শিল্পের অবস্থা শোচনীয়। বাজেটে এইসব শিল্পের পুনরুজ্জীবনের কোন নির্দেশনা নেই। ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি উদ্যোক্তারা কার্যত: সরকারের নগদ সাহায্য ও প্রণোদনার বাইরে। কর্মসংস্থানের কার্যকরি ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেই। দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের তুলনায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খুবই সীমিত। নিঃস্ব ও অতিদরিদ্রদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থাসহ খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোন ব্যবস্থা নেই।
সংবাদ সম্মেলনে সাাইফুল হক বলেন, দুর্যোগকালীন সময়ে সরকার পরিচালনার ব্যয় যখন কমানো দরকার ছিল তখন এই ব্যয় আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে। সামরিক খাতসহ অনুৎপাদনশীর খাতসমূহে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতাহীন মেগা প্রকল্পসমূহে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের উৎপাদন যখন উদ্বৃত্ত তখন রুপপুর পারমানবিক প্রকল্পে ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের যুক্তি কোথায় ?
গত অর্থবছরের বাজেট কেন বাস্তবায়ন করা গেল না বাজেটে তার কৈফিয়ত বা ব্যাখ্যা নেই। বস্তুত: সরকারের রাজনৈতিক ও নৈতিক শক্তি না থাকায় নিজেদের ঘোষিত বাজেটও তারা বাস্তবায়ন করতে পারছে না।
সকালে সেগুনবাগিচায় সংহতি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই বাজেট প্রত্যাখান করে পার্টির ১২ দফা প্রস্তাব অনুযায়ী বাজেটকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানান। পার্টির ১২ দফা প্রস্তাবনা নিম্নরূপ :
বাজেট নিয়ে যে হৈচৈ তা জুন মাস পর্যন্ত। এরপর বাজেট সংক্রান্ত আলোচনা আর তাপ-উত্তাপ হিমাগারে চলে যায়। ত্রৈমাসিক বা ষান্মাষিক পর্যায়ে বাজেট বাস্তবায়নের কোন পর্যালোচনা নেই।
এই অবস্থায় আমরা প্রস্তাবিত বাজেট প্রত্যাখান করছি এবং নিম্নোক্ত প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাজেটকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানাচ্ছি। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটের জন্য বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাসমূহ নিম্নরূপ:-
এক॥ করোনা মহামারী ও মহামারীজনীত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, খাদ্য-কর্মসংস্থান এবং কৃষি ও গ্রামীণ খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানের নীতি গ্রহণ এবং সে অনুযায়ী বাজেট পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদান করতে হবে।
দুই॥ জনগণের স্বাস্থ্যকে সম্পদ বিবেচনা করে দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য ‘গণস্বাস্থ্য’ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। করোনার পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যয়ভার রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে। ১৮ বছরের উপর দেশের সকল মানুষকে এই বছরের মধ্যে করোনা টিকা প্রদান কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দ্রুত টিকা আমদানির পাশাপাশি দেশে করোনার টিকা উৎপাদনের সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
তিন॥ কৃষি ও গ্রামীণ খাতের পুনরুজ্জীবন ও উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে উন্নয়ন বাজেটের ন্যূনতম ৩০ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করতে হবে। কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র প্রকল্প, মৎস্য, দুগ্ধ ও পোল্ট্রির মত উৎপাদনশীল উদ্যোগকে আর্থিক প্রণোদনা ও সাহায্য নিশ্চিত করতে হবে।
চার॥ ‘তেলের মাথায় তেল’ দেবার নীতি পরিহার করে মাঝারি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক শিল্প উদ্যোক্তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে প্রণোদনা প্রদান করতে হভে। পাদুকা শিল্পের মত গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাতসমূহকে কার্যকরি সহযোগিতা দিতে হবে।
পাঁচ॥ জাতীয় শিল্প রক্ষায় বন্ধ পাটকল-চিনিকল চালু করতে হবে। বেকারদের কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার প্রদান এবং আত্মকর্মসংস্থানের উদ্যোগসমূহকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
ছয়॥ দারিদ্রসীমার নীচে নেমে আসা দেশের নিম্নআয়ের শ্রমজীবী- মেহনতি-দিনমজুর ও গরীব আড়াই কোটি পরিবারসমূহের জন্য আগামী ৬ মাস প্রয়োজনীয় খাদ্য ও নগদ অর্থ প্রদানে বরাদ্দ থাকা দরকার। শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য স্থায়ী গণবন্টন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বাজেটে পরিস্কার নির্দেশনা ও বরাদ্দ রাখতে হবে।
সাত॥ রাজস্ব ব্যয় তথা সরকার পরিচালনার খরচ কমাতে হবে। বিলাসদ্রব্যের আমদানী ও রাষ্ট্রীয় অপচয় বন্ধ করতে হবে। সামরিক খাত সহ অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ কমিয়ে আনা প্রয়োজন।
আট॥ কালো টাকা সাদা করার কৌশলী নীতি বাতিল করে কালো টাকা, অপ্রদর্শিত অর্থ-সম্পদ ও বিদেশে পাচার করা উদ্ধার করার কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে হবে। সকল ধনী ও বিত্তবানদেরকে করের আওতায় নিয়ে এসে তাদের উপর বর্ধিত কর আরোপ করে রাজস্ব আয়বৃদ্ধির কৌশল নিতে হবে।
নয়॥ মেগা প্রকল্পে জবাবদিহীতাবিহীন ব্যয়বৃদ্ধির বর্তমান ধারা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে।
দশ॥ পরিবহন ভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, বাড়ী ভাড়া ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের নীতি গ্রহণ করতে হবে। সকল স্তরে মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও বাজার সিণ্ডিকেটসমূহের দৌরাত্ম বন্ধ করতে হবে।
এগার॥ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে হবে। শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারসমূহকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।
বার॥ দেশের বিপর্যস্ত দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে বিশেষ মনযোগ ও বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। প্রাণ-প্রকৃতি-জীববৈচিত্র সংরক্ষণে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য বহ্নিশিখা জামালী, আকবর খান, আবু হাসান টিপু, সাইফুল ইসলাম, মহানগর কমিটির আবুল কালাম, ছাত্র সংহতির নেতা রফিকুল ইসলম অভি, তিথি সুবর্ণা প্রমুখ।