মঙ্গলবার ● ১৩ এপ্রিল ২০২১
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী- দেশের উল্টোযাত্রা (২য় অংশ) : সাইফুল হক
স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী- দেশের উল্টোযাত্রা (২য় অংশ) : সাইফুল হক
বাংলাদেশ এবছর তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে। এই পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ তার ঘোষিত লক্ষ্যের দিক থেকে কতটা এগুলো এটা নিশ্চয় একটি গুরুত্বপূর্ণ মনযোগের বিষয়। গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের মারাত্মক অবনমন ঘটেছে। এটা জানার জন্য দেশের মানুষের প্রতিদিনকার তিক্ত ও বৈরী অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট। আন্তর্জাতিক নানা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমও গত প্রায় এক দশক ধরে তথ্য উপাত্ত দিয়ে একথা বলে আসছে। মানবাধিকার সূচকও খুবই নিম্নগামী। সাংবাদিকতাসহ মত প্রকাশের সুযোগের সূচকও খুবই হতাশজনক। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক অগ্রগতির বেশ কিছু সূচকে দেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে। এই সাফল্য ও অগ্রগতির পাশাপাশি বাংলাদেশ সেইসব দেশের সারিতে যেখানে অতিদ্রুত কোটিপতিদের সংখ্যা বাড়ছে। ধনী-গরীবের পার্থক্যও বেড়ে চলেছে মারাত্মকভাবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি-আদর্শের দিক থেকে পঞ্চাশ বছর পর এখন এই দেশের গতি ও প্রবণতা কি এটাও এখন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল- ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার’। এটাই ছিল স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। পঞ্চাশ বছর পর এই ঘোষণার দিশায় বাংলাদেশ আর নেই। ঘোষণার বিপরীতমুখী যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ তার উষালগ্ন থেকেই। ভূত নাকি পিছনে হাটে। বাংলাদেশ কেবল পিছনে নয়, পুরোপুরি উল্টো দিকে হাটছে। নানা দিক থেকে দেশ অকার্যকরি হয়ে উঠছে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে দেশ তার স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং একটি শোষণ-বঞ্চনামুক্ত আধুনিক গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র ও সমাজ হয়ে ওঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিল বস্তুত: ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর এর ঐতিহাসিক বিজয়ের পর থেকেই জনগণের অধিকার আর মুক্তির স্বপ্ন আকাংখা একের পর এক ফিকে হতে থাকে; তাদের আশা হতাশায়, আর স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে থাকে। কোটি কোটি মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হল, সেই রাষ্ট্রে সরকার গঠিত হল একটি দলের, আওয়ামী লীগের। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের আওতায় যারা এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হল স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নের। এই প্রক্রিয়ায় বৃটিশ ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানী জমানার প্রায় ঔপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটাকেই মুক্তিকামী বিজয়ী জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া হল। গত পাঁচ দশকে এই আমলাতান্ত্রিক জবাবদিহীহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই ক্রমে শক্তিশালী করা হয়েছে; যা এখন জনগণের গণতান্ত্রিক আকাংখার প্রতিপক্ষ হিসাবে দানবীয় এক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।
গত পঞ্চাশ বছর ধরে রাষ্ট্রকে দমনমূলক চরম কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে বস্তুত: জবাবদিহীতাহীন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চরম অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার প্রধান বাহন হিসাবেও গড়ে তোলা হয়েছে গোটা এই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকলে দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানানো যায়। রাষ্ট্রক্ষমতা এখানে স্বর্গপ্রাপ্তির সমতুল্য। একারণে শাসকশ্রেণীর সকল পক্ষই যেকোনভাবেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়; কেউই বিরোধী পক্ষে থাকতে চায়না। শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন পক্ষই ক্রমে রাষ্ট্রকে এই পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বিরোধী পক্ষে থেকে রাষ্ট্রকর্তৃক তারা দমন-পীড়নের শিকার হলেও ক্ষমতায় যেয়ে তারাই আবার তাদের বিরোধী পক্ষকে দমনে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আরো নিপীড়ণমূলক রয়েছে। একারণে ক্ষমতাসীন শাসকশ্রেণী ও তাদের সরকারের পাশাপাশি এই রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন জনগণ ও তাদের গণতান্ত্রিক আকাংখার প্রতিপক্ষ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় জনগণের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও ভূমিকা যত কমেছে রাষ্ট্র ও তত সর্বসংহারি গণবিরোধী প্রতিষ্ঠান হিসাবে হাজির হচ্ছে। একারণে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর এই রাষ্ট্রের বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আজ জনগণের দিক থেকে বড় এজেন্ডা হিসাবে উপস্থিত হয়েছে।
এই সমযকালে শাসকশ্রেণী ও তাদের ক্ষমতাসীন সরকারসমূহ রাজনীতিতে ন্যূনতম সহনশীল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারেনি, বরং বিরোধী পক্ষকে নিঃশেষ করার মধ্য দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ও কর্তৃত্ব নিশ্চিত করতে চেয়েছে। এই লক্ষ্যে হিংসা-বিদ্ব্যেষ ছড়ানোকে তারা অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করেছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তরে বিরোধ বিভাজন এক ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করেছে। সম্ভব হোলে তারা পাড়া, মহল্লা, গ্রাম, হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট, স্কুল, মসজিদ, ক্লাব প্রভৃতি সবকিছুই আলাদা করে ফেলে। এই ঘৃণা আর বিদ্ব্যেষেরই সহিংস প্রকাশ দেখা যায় বিরোধী রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত নজিরবিহীন দমন-পীড়নের হাজারো রকম ঘটনার মধ্য দিয়ে। একে রসদ জোগায় এক ধরণের মতাদর্শিক আর রাজনৈতিকভাবে আক্রমনাত্মক আধিপত্যবাদী প্রচার-প্রচারণা। রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে হিংসা-ঘৃণা-সহিংসতার এসব উপাদান গৃহবিবাদ থেকে গৃহযুদ্ধের উপাদান তৈরী করে চলেছে। বস্তুত: গত এক দশক ধরে বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ের এক গৃহযুদ্ধাবস্থা বিদ্যমান রয়েছে। গত এক দশকে কখনও পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, আবার কখনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে কিনা সেটা প্রধানত: নির্ভর করছে সরকার ও সরকারি দলের তৎপরতা ও পদক্ষেপের উপর।
পরিস্থিতির মধ্যে যেটুকু আপাত শান্তি ও ভারসাম্য রয়েছে তার বড় কারণ বিরোধী রাজনীতির প্রতি জনগণের বিপুল সমর্থন আর বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সহাবস্থানের মনোভাব। নানা কারণে জনগণের বিরাট অংশ বিরোধী রাজনীতির সমর্থনে মাঠে না নামলেও সরকারের কর্মকান্ড প্রত্যাখ্যানে তাদের মনভাব খুব স্পষ্ট। আর বাংলাদেশের বিকাশমান বিশাল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যেকোন চরমপন্থার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও স্পষ্ট। এই মধ্যবিত্তরাই এখন দেশের রাজনৈতিক সমাজের বড় অংশ। তারা তাদের জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তার জন্য এক ধরনের স্থিতিশীলতার পক্ষেই প্রকারান্তরে অবস্থান নিচ্ছে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় তারা বিক্ষুব্ধ সন্দেহ নেই; কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণী বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিবর্তনের জন্য এখনও তারা বড় কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয়। নিশ্চিত কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা গেলেই কেবল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক বড় অংশ হিসেবী ঝুঁকি নিতে এগিয়ে আসবে।
স্পষ্টতই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও অস্থির, অনিশ্চিত ও তরল। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কুশিলবদের মধ্যে যতক্ষণ ন্যূনতম বোঝাপড়া ও ভারসাম্য থাকবে ততসময় সরকারও খানিকটা নিরাপদ, রাজনৈতিক পরিমন্ডলে পরিবর্তনকামী বড় কোন জাগরণ ও জোয়ার ছাড়া এই ভারসাম্যে ফাটল সৃষ্টি প্রায় অসম্ভব। অতীত অভিজ্ঞতাও এই কথাই বলে। মাঠের-রাজপথের গণজাগরণ-গণবিষ্ফোরণের অভিঘাতেই কেবল রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে ফাঁক-ফোকর তৈরী হয় এবং পরিবর্তন নিশ্চিত জেনেই তারা পক্ষ পাল্টে ফেলে।
শাসকশ্রেণীর সমগ্র রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আগে রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, এমনকি নাগরিক সমাজ-বুদ্ধিজীবীদের যে গুরুত্ব ছিল তা এখন অনেকখানি সংকুচিত হয়েছে, খর্ব হয়েছে। এখন এই রাজনীতির মধ্যে বিত্তবান লুটেরা পরিবার ও অর্থনৈতিক মাফিয়াদের ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মাফিয়া সিন্ডিকেট এখন নানাভাবে ক্ষমতাসীন দলে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এদের সাথে যুক্ত রয়েছে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নানা স্তরের কুশিলবেরা। বস্তুত: এরাই এখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রধান নিয়ন্ত্রক। এদের বড় অংশের বিশেষ কোন মতাদর্শ ও নীতি নেই। এদের প্রধান প্রণোদনা হচ্ছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে দ্রুত অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলা। নিজেদের মধ্যে কিছু কিছু বিরোধ থাকলেও নিজেদের শ্রেণী ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ ও সুবিধাবাদিতা এদেরকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারছে।
এই সময়কালে দেশে নাগরিক সমাজও বিশেষভাবে দুর্বল হয়েছে। নাগরিক সমাজের দৃষ্টিগ্রাহ্য স্বাধীন কার্যকরি ভূমিকা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক হ্রাস পেয়েছে। নাগরিক সমাজের বড় অংশই ভীরুতা, আপোষকামীতা ও সুবিধাবাদিতায় আক্রান্ত হয়েছে। সাধারণ সত্য উচ্চারণ ও ন্যূনতম ঝুঁকি নিতেও এখন তাদের প্রবল অনীহা। এদের বড় অংশ এখন শাসকদলের সাথেই নানাভাবে সম্পর্কিত। সরকারী প্রভাব বলয়ে থাকা আর সরকারি দয়া-দাক্ষিন্ন আর অনুকম্পা পেতেই তাদের আগ্রহ বেশী। এদের স্বল্পসংখ্যকই বিরোধী দল ও বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের সাথে সম্পর্কিত রয়েছেন; বলা চলে তাও যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নাগরিক সমাজ বা বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই এখন প্রধানমন্ত্রীর সাথে একবার বিদেশ যেতে পারলে তাদের কাউকে একটা প্রতিষ্ঠানে বসিয়ে দিলে, গণভবন বা বঙ্গভবনে দাওয়াত পেলে বা রাষ্ট্রীয় কোন পদক পেলেই তারা বর্তে যান। সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ এই মানুষদের মনস্তত্ব বুঝে এদেরকে নানা ধরণের ডেট বা উৎকোচ দিয়ে তাদের পক্ষভুক্ত করে নিয়েছে। এসবের বাইরে যারা আছেন তাদেরকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নিবর্তনমূলক নানা কালো আইন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা চাপ ও হুমকীর মধ্যে রাখা হয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেও যারা কথা বলছেন, লিখছেন, নানা ইস্যুতে ভূমিকা রাখছেন তাদেরকে যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যেই এসব তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হচ্ছে।
পরিস্থিতি এতটাই নীচে নেমেছে যে, বুদ্ধিজীবী বলতে এখন দলীয় বুদ্ধিজীবী বোঝানো হচ্ছে। দেড় দুই দশক আগে পর্যন্ত রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলসমূহের মাঝখানে জনগণের চিন্তা-চেতনা ও আকাংখা নানাভাবে ব্যক্ত করা এবং এর মধ্য দিয়ে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উপর যতটুকু প্রভাব বা চাপ তৈরী করতে পারতেন এখন আর তারা সেই ভূমিকায় নেই বলা চলে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা নিবর্তনমূলক আইনের মধ্য দিয়ে নাগরিক অধিকার ক্রমাগত সংকুচিত হতে থাকায় বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা আরো হ্রাস পেয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী গত পাঁচ দশকে ভাবাদর্শ, সংস্কৃতি ও মননকাঠামোর দিক থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজে সাম্যভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার অবনমন ঘটেছে; কুপমডুক, ধর্মান্ধ, নিয়তিনির্ভর ও চরম দক্ষিণপন্থী ভাবাদর্শ ও চিন্তা চেতনার বিস্তার ঘটেছে; দৈনন্দিন জীবনে কিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে; কিন্তু মননজগত ও সংস্কৃতির মধ্যে ধর্মান্ধতার আছর প্রবল হয়েছে। শাসকশ্রেণীর অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই কম-বেশী ধর্মাশ্রয়ী দলে পর্যবসিত হয়েছে। সাংবিধানিক দিক থেকেও নানাভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে বহাল রাখা হয়েছে; রাজনৈতিক প্রয়োজনে ক্ষেত্র বিশেষে তাকে উসকিয়ে দেয়া হচ্ছে।
সুবর্ণজয়ন্তীর এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জনগণের ভোটের সাধারণ গণতান্ত্রিক অধিকার অস্বীকৃত, বিরোধী দল ও মতের পরিসর একেবারেই সীমাবদ্ধ। ততটুকু অধিকার দেয়া হচ্ছে, যতটুকু সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। কিন্তু সরকার কেবলমাত্র কামান-বন্দুক বা গায়ের জোরেই ক্ষমতায় নেই; তারা তাদের প্রবল কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসীবাদী শাসনকে সংহত ও প্রলম্বিত করতে, তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার পিছনে মানুষের এক ধরণের সম্মতি আদায়ে বহুমাত্রিক আগ্রাসী তৎপরতাও অব্যাহত রেখেছে। তারা এমন ধারণা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছে যে, ‘উন্নয়নের’ জন্য তাদের কোন বিকল্প নেই। বিপদজনক হচ্ছে দেশের গোটা ইতিহাসও তারা দখলে নিতে মরিয়া; যে ইতিহাসে বস্তুত: একজন ব্যক্তি, একটি পরিবার ও একটি দলছাড়া কোথাও আর কারই উপযুক্ত মর্যাদা ও স্বীকৃতি নেই। এটাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য রাষ্ট্রের হাজারো কোটি টাকা ব্যয়েও তারা দ্বিধাহীন। আর ফ্যাসিবাদকে প্রায়শই পপুলিজম এর উপর নির্ভর করতে হয়। সেই লক্ষ্যেও তাদের বহুমাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কোন পথে হাটবে, জনগণের দিশাই বা কি হবে এটা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সুরাহা না হলে, জনগণের সামনে ইতিবাচক দিশা হাজির না থাকলে দেশ ও জনগণের আরও সমূহ বিপদ। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র হিসাবে তার অকার্যকারিতার শর্তগুলোই কেবল বাড়তে থাকবে।
দিশা যদি স্বাধীনতার ঘোষণা “সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা” হয় তাহলে তার জন্য প্রয়োজন হবে নতুন রাজনৈতিক শক্তি, জনগণের নবতর জাগরণ। এজন্যে এই একবিংশ শতাব্দীতে স্বাধীনতার ঘোষণাকে ভিত্তি করে সাম্যভিত্তিক গণতান্ত্রিক, মানবিক ও জবাবদিহিমূলক নতুন ধরণের বৈপ্লবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যাবে- সে সম্পর্কে পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিসমুহের মধ্যে বোঝাপড়া গড়ে তোলা জরুরী।
সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরে যদি এটুকু কাজ এগিয়ে নেয়া যায় সেটা নিশ্চয়ই এক বড় অগ্রগতি হিসাবেই বিবেচিত হবে।
নিউ ইস্কাটন, ঢাকা
৩০ মার্চ, ২০২১।