সোমবার ● ৮ জুন ২০২০
প্রথম পাতা » ছবিঘর » অব্যবস্থাপনা করোনা সংকটকে প্রকট করে তুলেছে
অব্যবস্থাপনা করোনা সংকটকে প্রকট করে তুলেছে
নানা ধরনের রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের মানুষ অভ্যস্ত হলেও করোনা মহামারীর মতো স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ নিকট অতীতে আর মোকাবিলা করতে হয়নি। দুনিয়ার অনেক দেশের মতো আমাদের জন্যও এই পরিস্থিতি অদৃষ্টপূর্ব। চীন ও পশ্চিম ইউরোপের কটি দেশের করুণ অভিজ্ঞতার পর আমাদের প্রস্তুতির জন্য প্রায় দুই মাস যে সময় পাওয়া গিয়েছিল সংক্রমণ মোকাবিলায় তা আমরা উপযুক্তভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। কভিড-১৯ নামক এই ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পর্কেও আমাদের বিশেষজ্ঞ, ডাক্তার ও নীতিনির্ধারকদের পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল না; বরং সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও হয়তো অপ্রমাণিত বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে এ ধারণাই দেওয়া হয়েছে যে, করোনাভাইরাস আমাদের জন্য পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অতটা বিপজ্জনক ও প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে না। উদ্বেগটা এখানে যে, এখনো পর্যন্ত তাদের অনেকের মধ্যে ‘বিপজ্জনক না হয়ে ওঠার’ ধারণাটি বোধ করি যথেষ্ট প্রবল। এই মে মাসকে যখন করোনা সংক্রমণের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসাব বলা হচ্ছে, তখন ‘স্বাভাবিক জীবনযাত্রার’ কথা বলে ‘সীমিত আকারে’ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ঈদের কেনাকাটার জন্য মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্স, অফিস-আদালত খুলে দেওয়া হচ্ছে। একদিকে ভাইরাস থেকে বাঁচতে সাধারণ ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি, লকডাউন, আইসোলেশন আর অন্যদিকে অপ্রস্তুতি ও অপরিকল্পিতভাবে সংক্রমণের ব্যাপক বিস্তারকালে বস্তুত অনেক কিছুই উন্মুক্ত করে দেওয়া একদিকে মারাত্মক সমন্বয়হীনতা আর অন্যদিকে স্ববিরোধী ও বৈপরীত্যেরই বহিঃপ্রকাশ। কথা ছিল পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও শ্রমিক-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে ‘সীমিত আকারে’ গার্মেন্টস কারখানা চালু করা হবে। অথচ এর মধ্যে চাকরি বাঁচাতে অধিকাংশ কারখানাতেই ৯০ শতাংশ গার্মেন্টস শ্রমিক অনিরাপদ পরিবেশে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই কাজে যোগ দিয়েছেন; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই, শারীরিক দূরত্ব বলেও কিছু নেই।
ফলে আইইডিসিআরের তথ্যই বলছে করোনার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রামে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্ত হচ্ছেন ডাক্তার, নার্স, চিকিৎসাসেবী, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ সমাজের প্রায় সব অংশের মানুষ। মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। এ রকম একটি অবস্থায় প্রবল ঝুঁকির মধ্যে ঈদ কেনাকাটার কথা বলে ‘সীমিত আকারে’ মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্স, কিছু অফিস-আদালতসহ বস্তুত সবকিছু খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত যে আত্মঘাতী ও প্রকট সমন্বয়হীনতার নজির, তা পরিষ্কার। ‘সীমিত আকারে’ ‘স্বাস্থ্যবিধি ও শারীরিক দূরত্ব’ বজায় রাখার ঘোষণা যে নেহাত কথার কথায় পরিণত হয়েছে, তা কারও অজানা নয়। গার্মেন্টস মালিকদের পর সরকার কি অন্য ব্যবসায়ীদের চাপের কাছেও নতি-স্বীকার করল ইতিমধ্যে এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া ও বারবার মিউটেশনের মধ্য দিয়ে এ দেশে দুর্বল হয়ে আসা করোনাভাইরাস ও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে অভ্যস্ত দেশের মানুষের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা, ইত্যাকার কথিত বিষয়সমূহ যদি আমাদের পরোক্ষভাবে কোনো সহযোগিতা জুগিয়ে না থাকে, তাহলে সামাজিক সংক্রমণের ব্যাপক বিস্তারের মধ্য দিয়ে মহামারী যে ভয়ংকর চেহারা নেবে আর তা সামাল দেওয়ার কোনো ক্ষমতাই যে আমাদের নেই, গত দুমাসে তা প্রকটভাবেই ধরা পড়েছে।
৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর এখনো সংক্রমণ পরীক্ষা, পরীক্ষার কিট, ডাক্তার-নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা, অক্সিজেন, ভেন্টিলেশনসহ সমগ্র করোনা চিকিৎসাব্যবস্থা বেহাল, বিশৃঙ্খল, অকার্যকর ও গুরুতরভাবে সমন্বয়হীন। ঢাকার দুটি করোনা চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। আইইডিসিআর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত এ-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি ও তারপর গঠিত পরামর্শক কমিটির কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ, তাদের তৎপরতাও দৃষ্টিগোচর নয়। ঢাকার বাইরে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার অবস্থা আরও শোচনীয়।
ডাক্তার, নার্সসহ চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে করোনা আতঙ্ক, সিলেটে ডা. মঈন উদ্দিনের মৃত্যুসহ আরও কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ও অব্যবস্থাপনা এই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অধিকাংশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে এই স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ সামাল দেওয়ার কাজে এখনো যুক্ত করা যায়নি। সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সম্পৃক্ত করে ন্যূনতমভাবে জেলাসমূহে কার্যকর করোনা হাসপাতালসহ ফিল্ড হাসপাতাল তৈরির যে সুযোগ ছিল, তাও হয়নি। ফলে এশিয়ার মধ্যে করোনা সংক্রমণ পরীক্ষা ও সুস্থতায় বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে। আর করোনা সংক্রমণের এই দু-তিন মাসে সাধারণ চিকিৎসাব্যবস্থা যেভাবে ভেঙে পড়েছে, তা নজিরবিহীন।
এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, স্বাধীনতার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরও আমরা এখনো দেশের মানুষের জন্য কার্যকর ও টেকসই কোনো গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারিনি। বাজেটে খুবই অপ্রতুল বরাদ্দই তার নজির। মনুষ্যসৃষ্ট বা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারীতে সবচেয়ে অসহায় ও ভঙ্গুর অবস্থায় পড়েন ব্যাপক সাধারণ মানুষ। এই ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জন্য বা মহামারীজনিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে ঢেলে সাজানো জরুরি করোনা মহামারী এই ছবকও আমাদের ভালোভাবে দিয়েছে। ভবিষ্যতে মানবজাতিকে যে আরও নতুন নতুন প্রাণঘাতী ভাইরাসের সম্মুখীন হতে হবে, এই আশঙ্কা বিবেচনায় রেখেই সমগ্র স্বাস্থ্য খাতসহ সামাজিক নিরাপত্তা খাতসমূহকে উন্নয়ন পরিকল্পনায় অগ্রাধিকারে নিয়ে আসা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহামারীজনিত পরিস্থিতির উদ্বেগজনক গভীরতা বিবেচনায় রেখে এই স্বাস্থ্যগত জাতীয় দুর্যোগে যে ধরনের সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ ও জাতীয় সংহতি দরকার ছিল, তা হয়নি। প্রায় একটা যুদ্ধকালীন সময়ের মতো সব দল, মত ও জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে যা কিছু সম্পদ ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে দুর্যোগ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ও মানুষকে রক্ষা করার যে জাতীয় কর্তব্য ও সুযোগ তৈরি হয়েছিল, সরকার তাকে কাজে লাগাতে পারেনি। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ ও জনগণের নানা অংশের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হলেও বিস্ময়করভাবে সরকার তাতে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ধরনের দুর্যোগ সরকার বা কোনো দলের যে এককভাবে মোকাবিলা করার বিষয় নয় এবং তা করতে গেলে দুর্ভোগ ও দুর্গতি যে আরও প্রলম্বিত হয়, আমাদের নীতিনির্ধারকদের এই উপলব্ধির ক্ষেত্রেও রয়েছে গুরুতর ঘাটতি। সরকারের রাজনৈতিক ও নৈতিক গ্রহণযোগ্যতার যে ঘাটতি রয়েছে, মহামারী পরিস্থিতি সেই ঘাটতি খানিকটা কাটিয়ে ওঠারও একটা সুযোগ করে দিয়েছিল। সরকার এই সুযোগটাকেও কাজে লাগাতে পারেনি। সরকার এখনো পর্যন্ত ‘একলা চলো নীতি’ অনুসরণ করে চলেছে। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলছেন; অথচ এই ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছেন না।
চরম অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার অসংখ্য ঘটনা ঘটছে চালসহ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর কর্মসূচিতে। চুরি, দুর্নীতি, অনিয়ম, দলীয়করণ ইতিমধ্যে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে; যার অধিকাংশের সঙ্গে সরকারি দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসছে। এ কারণে কথিত এসব জনপ্রতিনিধির ওপর নির্ভর না করে ৬৪ জেলার ৬৪ জন সচিবকে সমন্বয়ের দায়িত্ব দিতে হয়েছে। অথচ অব্যবস্থাপনা এখনো দূর হয়নি। সরকার যে প্রক্রিয়ায় চালসহ ত্রাণ বিতরণ করে আসছে, তাতে একদিকে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে আর অন্যদিকে ক্ষুধাপীড়িত শ্রমজীবী ও দিনমজুরদের এক বড় অংশ এখনো পর্যন্ত খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী পাওয়া থেকে বঞ্চিত। স্বল্প আয়ের মানুষ সরকারের কাছ থেকে এ ধরনের দান-খয়রাত চায় না। দেড়-দুই কোটি পরিবারকে কমপক্ষে আগামী কয়েক মাসের জন্য রেশনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। সশস্ত্র বাহিনীসহ সব বাহিনীকে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি পরিবারের কাছে খাদ্য ও নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়া অসম্ভব নয়। বলা হচ্ছে, আমাদের আট মাসের খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এখন দরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা, এখনো যে এক বড় জনগোষ্ঠীর কাছে খাদ্য পৌঁছায়নি তার কারণ কোনোভাবেই খাদ্যসংকট নয়, বরং নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা, চুরি ও দুর্নীতি।
করোনা দুর্যোগের মধ্যে একটা ভালো সংবাদ হচ্ছে হাওর অঞ্চলসহ দেশব্যাপী এই বছরও বোরো ধানের বাম্পার ফলন। সরকার এবার সাত লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ধান কেনার এই পরিমাণ ২০ লাখ টনে উন্নীত করা সম্ভব। জরুরি ভিত্তিতে গুদাম নির্মাণ করে বা প্রয়োজনে কৃষকের গোলাঘরকে অস্থায়ী গুদামে পরিণত করা যেতে পারে। সরকারি গুদাম খালি হলে বা তৈরি হলে দু-এক মাস পর সেই ধান নিয়ে আসা যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রকৃত চাষি যাতে সরকার নির্ধারিত মণপ্রতি ১০৪০ টাকা দাম পায় আবশ্যিকভাবে তা নিশ্চিত করা।
মহামারীজনিত এই প্রতিকূল সময়ে স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসেবা, খাদ্য-ত্রাণ, নগদ অর্থ ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছানো এবং কৃষি ও গ্রামের খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে উৎপাদন, পরিবহন, বিপণন ও বিতরণের সমগ্র ব্যবস্থাকে সচল রাখা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারলে মহামারীর এই কৃষ্ণপক্ষ থেকে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বেরিয়ে আসা অসম্ভব নয়।
নিউ ইস্কাটন, ৬ মে, ২০২০
লেখক : সাইফুল হক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক।