বুধবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৩
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » বর্ষবরণ আর উৎসবের রঙ কবে সার্বজনীন হবে ?
বর্ষবরণ আর উৎসবের রঙ কবে সার্বজনীন হবে ?
সাইফুল হক :: ২০২৩ সাল ও শুরু হোল নানা দিক থেকে বিপন্ন এক অনুভূতি নিয়ে। দুনিয়ার তামাম দেশ আর তাদের শহর বন্দরগুলো নববর্ষ বরন করল বিচিত্র সব আতস বাজির বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে। আশা আতস বাজির মত নতুন বছরটাও আলোকোজ্জ্বল হবে, রংগিন হবে, বৈচিত্রময় হবে। বছর জুড়ে জনগোষ্ঠীর একাংশের জীবন হয়তো এরকমই হয়।এরকম জীবনের জন্যইতো মানুষের অবিরাম অন্তহীন প্রচষ্টা, যাপিত জীবনের আকুতি।
বাংলাদেশেও, বিশেষ করে বড় বড় শহরগুলোতে বিগত বছরগুলোর মত পুলিশী নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও আতসবাজি, ফানুস আর ড্রোন উড়িয়ে নতুন আশা নিয়ে ইংরেজি নতুন বছর বরন করে নেয়া হল। ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে বাসার বারান্দা থেকে এরকিছুটা দেখার সুযোগ হল।কিন্তু আতস বাজির ক্ষনিক বিচ্ছুরণের সাথে সাথে এখানে সবই যেন মিলিয়ে যায়,হারিয়ে যায়। আলোকোজ্জল আশা জাগানিয়া াদিনের স্বপ্ন আর আশা গুলো হতাশায় মরতে মরতে কেবল শুকিয়ে যেতে থাকে।
ইংরেজি এই বর্ষবরনের উচ্ছ্াস ও আবার ছোট একটি বিত্তবান আধা বিত্তবান শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। শহরে বন্দরে মুষ্টিমেয় একটি শ্রেণী নানা আয়োজনে - সংগীত, উদ্দাম নৃত্য আর পানাহারে স্বশব্দে বর্ষবরনের বাঁধ ভাংগা আবেগে মেতে উঠে।গত ক’বছর ধরে আবার চালু হয়েছে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২ টা থেকে অপ্রয়োজনে হর্ণ বাজাতে বাজাতে গাড়ি চালানো। এ এক বিচিত্র আনন্দ আর উচ্ছ্াস! কিসে যে এদের পরমানন্দ বোঝা মুশকিল। কিন্তু এটা নিশ্চিত এদের অধিকাংশের চোখে বড় বা কাছে দূরে কোন স্বপ্ন নেই। এই মুহুর্তে আনন্দে ভেসে আত্মহারা হওটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রজন্মের এক বিরাট অংশ বিস্ময়কর রকম ঘটমান বর্তমান।
ছোটকাল থেকে এটা শুনে বড় হয়েছি যে,আনন্দ ভাগ করে নিলে আনন্দ নাকি বহুগুণ বেড়ে যায়, আর দুঃখ ভাগ করে নিলে দুঃখের ভার কমতে থাকে।
আপসোস আমাদের ভাগ বিভাজন, প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের সংস্কৃতিতে এখন আর এসবের বিশেষ বালাই নেই। সর্বত্র বিরোধ - বৈরিতা, প্রতিহিংসা আর জিঘাংসার উপকরণ। একের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যেন অন্যের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়াস। সহযোগিতা বা বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা নয়, সব কিছুতে যেন প্রতিপক্ষকে বিনাশের আয়োজন!
আশা জাগানিয়া তেমন কিছু দেখা যাচ্ছেনা। উৎসব সমূহ সার্বজনীন হয়ে উঠছেনা।এটা শুনেও আমরা বেড়ে উঠেছি যে, ধর্ম যার যার উৎসব আর আনন্দ সবার। কিন্তু এসব অনুষ্ঠানও কালিমালিপ্ত হচ্ছে। মাঝে মধ্যেই এসব অনুষ্ঠান - ধর্মী প্রতিষ্ঠান হামলার শিকার হচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছে, কখনও কখনও ভস্মীভূত হচ্ছে, লুটপাটও হচ্ছে। এসব বিষয় আসয়ের ক্ষতি পরবর্তীতে খানিকটা হয়তো পুষিয়ে নেয়া যাচ্ছে, কিন্তু হৃদয়ের যে রক্তক্ষরণ, মনের যে ভাংচুর, ভ্রাতৃত্ব আর বন্ধুত্বে যে ফাটল তা কিভাবে জোড়া লাগবে, পারষ্পরিক সহযোগিতা আর সহমর্মিতায় যে বিভেদ তা কিভাবে দূরীভূত হবে ! ঘটনা ঘটবার আগেও যাকে অনায়াসে বিশ্বাস করা যেত এখন মনের অজান্তেই তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতে হচ্ছে। তার দিকে আর শর্তহীনভাবে তাকানো যাচ্ছে না, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা। এসব ক্ষতি অপূরনীয়, পুষ্পবনে পাগলা হাতির তান্ডবের মত। কিভাবে এর উপসম হবে? রাতারাতি কিভাবে একটা জনপদের আপন মানুষেরা অচেনা ঘাতকের সন্দেহের তালিকায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে তাবড়ই অদ্ভুত !
ব্যতিক্রম ছাড়া এধরনের প্রতিটি ঘটনাই কোননা কোন ভাবে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট; পরিকল্পিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই অধিকাংশ ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে। মানুষকে বিভক্ত করার সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে ধর্মের নামে বিভেদ,বৈরীতা,হিংসা আর ঘৃণার বিস্তার ঘটানো। রাজনৈতিক আর বৈষয়িক স্বার্থ সিদ্ধিতেও এর ফলাফল হাতেহাতে পাওয়া যাচ্ছে। এসব অপতৎপরতার সাথে যখন নানাভাবে রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক মদদ যুক্ত হয় তখন পরিস্থিতি সত্যি সত্যি ভয়ংকর হয়ে উঠে।
আমাদের অসাম্প্রদায়িক উৎসব সমূহও মাঝে মাঝে কালিমা লিপ্ত হলেও এখনও এসব উৎসবই আমাদের প্রাণের গাথুনি, হৃদয়ে হৃদয় যোগ করার বড় সেতুবন্ধন। জাতি,ধর্ম,বর্ণ,লিঙ্গ নির্বিশেষে এসব উৎসব - পার্বন আমাদেরকে যুথবদ্ধ রাখে, মানবিকতা আর সহমর্মিতার আকর হিসাবে কাজ করছে। সামাজিক আর সাংস্কৃতিক এসব আয়োজনেই আমাদের মানবিক বৈশিষ্টের প্রকাশ ঘটে, পারিবারিক, সামাজিক, সাম্প্রদায়িক বিভেদের প্রাচীর অতিক্রম করে আমাদেরকে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও অমৃতের সন্তানের গুণাবলিতে পরিপূর্ণ করে রাখে।শাসক শ্রেণী আর রাষ্ট্রের ভেদ বুদ্ধিকে পাশ কাটিয়ে আমরা সভ্য,গণতান্ত্রিক, আর মানবিক মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠি। জীবনে জীবন যোগ করে ক্ষুদ্র আর সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তার বাইরে যেয়ে প্রকৃতির অগ্রসর অংশ হয়ে উঠি, মানব জন্মের স্বার্থকতার আনন্দ ভাগা ভাগি করার প্রচেষ্টা নেই।
কিন্তু শ্রেণী শোষণ, শ্রেণী বিভাজন, শ্রেণী নিপীড়ন আমাদেরকে এক হতে, উৎসব আর পাল াপার্বনে আমাদেরকে যুথবদ্ধ হতে দেয়না, কোননা কোনভাবে আমাদেরকে বিভাজিত করে রাখতে চায়।ফলে উৎসব সমূহও সত্যিকার অর্থে সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনা, সবার ঘরে উৎসবের আনন্দ পৌঁছাতে পারেনা। একারণে নানা অনুষ্ঠান আর পার্বনও শেষ অব্দি বিশেষ শ্রেণী বৈশিষ্টের চেহারা নেয়; এজন্য নানা অনুষ্ঠানকে ঘেরা টোপের মধ্যেই রাখতে হয়। এই অবস্থায় আমজনতাকে তার কৌতুহল নিবৃত্ত রাখতে হয়, বড়জোর উঁকি ঝুঁকিতেই আনন্দ আর উচ্ছ্াসকে অবদমিত রাখতে হয়।
গত পাঁচ দশকে এই শ্রেণী বিভাজন, শ্রেণী বৈরীতা আরও প্রবল ও প্রকট হয়েছে। পাকিস্তানি জমানার মত একদেশে দুই সমাজ, দুই শ্রেণী, এক ধরনের দুই অর্থনীতির বিভেদ আর ফারাক কেবল আরও প্রশস্থ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার ব্রত থেকে বাংলাদেশ ও এখানকার শাসক শ্রেণী বলতে গেলে ১৮০ ডিগ্রী উল্টো দিকে অবস্থান নিয়েছে। ভুত নাকি পিছনে হাটে; এরাও এখন ভুতের মত পিছনে হেটে সাম্য আর মানবিক মেল বন্ধনের চৈতন্যকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দেশকে এখন তারা যোজন যোজন দূরে নিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এখন নিছক বুলিসর্বস্বতায় পর্যবসিত করা হয়েছে।
পাকিন্তানিরা ১৯৭০ সালে এদেশের মানুষের ভোটের রায় অস্বীকার করেছিল বলে আমাদেরকে একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হয়েছে, এদেশের জনগণের ভোটের রায়ের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হয়েছে। এখন সেই ভোটের অধিকারই অস্বীকৃত, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রবলভাবে সংকুচিত ; শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পথে সরকার পরিবর্তনের পথ রুদ্ধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা নিবর্তন মূলক কালা কানুনের চাপে মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা,ভিন্নমত, প্রতিবাদী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতা নানা ভাবে অবরুদ্ধ, নিয়ন্ত্রিত। সাধারণ সত্য উচ্চারণও রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ। সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমূহ ন্যুব্জ ও ছত্রভঙ্গ। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরমত সহিষ্ণুতার পরিবর্তে হিংসা, ঘৃণা, নিপীড়ন, নির্যাতন ও প্রতিশোধাত্মক আচরণ ভয়ংকর চেহারা নিয়ে আবির্ভূত। অথচ বিরোধী পক্ষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত না হলে নিজের অধিকারও যে সুরক্ষিত থাকেনা, ভিন মতাবলম্বীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে নিজেদের নিরাপত্তাও যে টেকসই হয়না - এইসব বোধ উপলব্ধি প্রায়অপসৃত।
এসব আদিম বা মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভংগী ও হিংসাত্মক বৈরী সংস্কৃতিতে গণঐক্য ও গণসংহতির পরিবর্তে ভাগ বিভাজন কেবল বিস্তৃতই হয়ে চলেছে। গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানুষকে প্রধানত ঐক্যবদ্ধ করে অগ্রসর ও মুক্তিকামী মতাদর্শ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির আধিপত্য ও প্রভাব বলয়ের বিস্তৃতি ঘটিয়ে, বল প্রয়োগ বলতে গেলে যেখানে একেবারে শেষ অবলম্বন; তাও একটি নির্দিষ্ট পর্যায় অব্দি। কিন্তু সর্বগ্রাসী বলপ্রয়োগই যদি সর্বক্ষেত্রে ক্ষমতা ও আধিপত্য টিকিয়ে রাখার সাধারণ নিয়মে পরিনত হয় তবে সেই রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের আয়ুকাল নাতিদীর্ঘ হতে বাধ্য। একবিংশ শতাব্দীতে এই মনোভাব কোন ভাবেই কাম্য হতে পারেনা।
রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিশ্চিত না হলে ব্যক্তির মানবিক মুক্তি ও তার অফুরন্ত সৃজনী সম্ভাবনার দরজা উন্মুক্ত হতে পারেনা; বৈশাবীর মত উৎসব আর পালা পার্বনওস ত্যিকারের রং ছড়াতে পারেনা; পারেনা মনের সাথে মন, আত্মার সাথে আত্মার সেতুবন্ধন ঘটাতে ; সামাজিক প্রজাতি হিসাবে ‘ অমৃতাস্য পুত্রার’ বৈশিষ্ট এখানেই। কবি এজন্যই লিখেছিলেন “সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই”। শ্রেণীহীন এক গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজই কেবল আমাদের উৎসব আর আনন্দকে সবার করে তুলতে পারে। আজ না হলে কাল,কাল না হলে পরশু জাতি,ধর্ম,শ্রেণী,বর্ণ ও লিঙ্গের বিভাজন মাড়িয়ে মানুষ এই মানবিক মুক্ত পৃথিবীর বাসিন্দা হবে- এই ‘ইউটোপিয়া’ বাস্তব হয়ে দেখা দেবে।
২১ মার্চ ২০২৩
নিউ ইস্কাটন, ঢাকা।