বৃহস্পতিবার ● ২ ডিসেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » সরকারের নীতি নির্ধারকদের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে মনোভাব, দৃষ্টি পরিবর্তন না হলে পার্বত্য অঞ্চলের ভুমি সমস্যা সমধান হওয়ার সম্ভবনা নাই
সরকারের নীতি নির্ধারকদের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে মনোভাব, দৃষ্টি পরিবর্তন না হলে পার্বত্য অঞ্চলের ভুমি সমস্যা সমধান হওয়ার সম্ভবনা নাই
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমূন্নত এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব-স্ব অধিকার সংরক্ষন এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চারি খন্ড (ক,খ,গ,ঘ) সম্মিলিত চুক্তিতে উপনিত হন।
১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহবায়ক আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ্ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস-মুল) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা সম্পাদিত এই চুক্তিতে সই করেন।
২রা ডিসেম্বর ২০২১ সালে পার্বত্য চুক্তির ২৪ বছর পূর্ণ হল। এই ২৪ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কি পেলেন আর কি হারালেন একটি পর্যালোচনা করা অতিব প্রয়োজন।
পার্বত্য চুক্তির আলোকে গঠন করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্স, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি কমিশন, পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (রাঙামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯, বান্দরবান পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯) এবং এর বিভিন্ন ধারা সমূহের পরিবর্তন, সংশোধন, সংযোজন ও অবলোপন করার মাধ্যমে গঠন করা হয় রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ। এর আগে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা প্রশাসন, তিন জেলার ২৫ উপজেলার উপজেলা প্রশাসন, তিন পার্বত্য জেলার পৌরসভা ও তিন পার্বত্য জেলার ইউনিয়ন পরিষদ বিদ্যমান ছিল। পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে শক্তিশালী করা হয় চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল ও মং সার্কেল চীফদের কার্যক্ষমতা। এর বাইরে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয় এর অধিদপ্তর/পরিদপ্তর আওতাধীন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্যালয় রয়েছে। এছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক এডিবির পার্বত্য চট্টগ্রাম পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প ও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সংস্থা। এর বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মূল্যায়ন কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তাকারী উপদেষ্টা কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি ইত্যাদি।
পার্বত্য চুক্তির প্রারম্ভে বেশ কিছু বিষয় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, তন্মধ্যে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমূন্নত এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে।
চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমূন্নত এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব-স্ব অধিকার সংরক্ষন এবং উন্নয়নের কথা থাকলেও কিন্তু কৌশলগত ভাবে পার্বত্য অঞ্চলে কয়েকশত বছর ধরে বসবাসকারী বড়ুয়া জনগোষ্ঠীকে পার্বত্য চুক্তিতে নাম অন্তর্ভুক্ত না করে বৃহত্তর ১টি পার্বত্য অঞ্চলে তাদের বসবাস বা অবস্থাকে অস্বীকার করা হয়েছে। এছাড়া সাঁওতাল, অহমিয়া ও গুর্খা জনগোষ্ঠীর কথাও চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পার্বত্য চুক্তির পর থেকে প্রতিটি স্থরে এবং রাজনৈতিক ভাবে পার্বত্য অঞ্চল বসবাসরত বড়ুয়া জনগোষ্ঠী বৈষম্যের শিকার এবং বড়ুয়া জনগোষ্ঠীকে পার্বত্য অঞ্চল থেকে উৎখাত করার সুদুর প্রসারী ষড়যন্ত্র।
পার্বত্য অঞ্চলে মাত্র কয়েক’শ জনের বসবাস পাংখোয়া, লুসাই (মিজু), চাক, খুমি, খিয়াং ও ম্রো জনগোষ্ঠীর জন্য যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালেয়ে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে এবং রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দারবান পার্বত্য জেলা পরিষদে কোটা সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে ১টি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বড়ুয়া, সাঁওতাল, অহমিয়া ও গুর্খা জনগোষ্ঠীর কোটা সংরক্ষণ করা যাবে না কেন ? পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারি দুই পক্ষ, দেশের গণতান্ত্রিক জনগণের সরকার নিশ্চয় বিষয়টি আমলে নিবেন।
পার্বত্য চুক্তির পূর্বে পার্বত্য অঞ্চলের বসবাসরত অধিবাসীদের যে রাজনৈতিক অধিকার ছিল চুক্তির পর ২৪ বছরেও আদৌ তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে পারেনি। এর পিছনে মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে আরো সৎ ইচ্ছা এবং আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন।
পার্বত্য চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় এবং রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিশ্চয় এই দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপুর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে যুক্ত করে দিতে পারেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে এধরনের গুরুত্বপুর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন আছে কিন্তু প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের কারণে বহিরাগতদের উপস্থিতি সংখ্যা বেড়ে গেছে। এর সমধান হতে পারে এধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতার ভিত্তিতে স্থানীয়দের নিজ-নিজ জেলায় নিয়োগ প্রদান করা।
পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত স্ব-স্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক উন্নয়ন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু ২৪ বছর পর সামাজিক অধিকারের বিষয়ে বলতে গেলে কাগজে-পত্রে অগ্রগতি হয়েছে, বাস্ত চিত্র একেবারে ভিন্ন। সামাজিক উন্নয়ন বা সম্প্রদায় উন্নয়ন বিষয়টির উপর পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য অঞ্চলে কাজ করে চলেছেন কিন্তু এর ফলাফল ২৪ বছর আগে যা ছিল বর্তমানেও তা দৃশ্যমান। বরঞ্চ সংঘাত, গুম, খুন হানাহানি আশংকাজনকভাবে বেড়েছে। যা নিরসনের জন্য কোন পক্ষই আন্তরিকভাবে কাজ করছেন না।
সরকার পার্বত্য অঞ্চলের পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে একজন নাগরিকের জন্মগত মৌলিক অধিকার ৫টির মধ্যে অন্যতম শিক্ষার অধিকার স্থানীয়দের হাতে ন্যস্ত করে পার্বত্যঞ্চলের বসবাসরত অধিবাসীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার যে সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে ২৪ বছর পর শিক্ষার মেরুদন্ডই ভেঙ্গে পড়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম এলাকায় গিয়ে দেখা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলিতে শিক্ষকদের উপস্থিতি নেই। একটি বিদ্যালয়ে ৫ জন শিক্ষক মিলে একজন বর্গা শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন, আর জেলা পরিষদ সমূহ ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে যাদের শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে তারা কখনো নিজেদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকেন না। তা ছাড়া বেশী ভাগ শিক্ষক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাদের আত্ময়ী-স্বজন। পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্ধ রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে ব্যয় করা হয় তা কেবল অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা সামগ্রী ক্রয়, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি বিষয়ে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এসবের সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীরা কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা পায়না। শিক্ষাখাতে ৫ লক্ষ টাকার সংস্কারমুলক কাজ করে ঠিকাদার বিল করেছে ৩১ লক্ষ টাকার, গত ২৪ বছরে মধ্যে এ অনিয়ম তদারকি করার কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। বিগত ২৪ বছরে হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলের এসএসসি, এইচএসসি শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়নি বললেই চলে। পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষার মান এতবেশী নীচে নেমে গেছে যে, অনেক স্কুলে পাশের হার ০%। শিক্ষকরা প্রত্যান্ত অঞ্চল ছেড়ে শহরে এসে রাজনীতি আর ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। ১টি জনগোষ্ঠী অনাথ আশ্রমের নামে দেশের মেধা পাচার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে প্রত্যান্ত অঞ্চলের পাহাড়ি ছেলে-মেয়েদের সরকারী টাকায় হোষ্টেলে রেখে কোটি-কোটি টাকা আয়, আশ্রম বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে ১০২ নং রাঙাপানি মৌজায় হাজার-হাজার একর ভুমি অবৈধভাবে দখল, বিএসটিএর অনুমোদন বিহীন রাঙামাটি জেলায় খাদ্য (বেকারী খাদ্য সামগ্রী) বিক্রয় করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইন্সেস ছাড়া কোটি-কোটি টাকা সুদের ব্যবসা করছে, রাঙামাটি পৌর এলাকায় স্থানীয় বাঙ্গালীদের তাদের বাপ-দাদার ভুমি থেকে উচ্ছেদের জন্য মামলা দিয়ে তাদের জমি বা সম্পদ আত্মসাত করার কাজে নিয়োজিত। কিন্তু পার্বত্য চুক্তির মারপ্যাচে স্থানীয় জনসাধারন অসহায়। শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবিক অবস্থানে ফিরে না গেলে শিক্ষা ক্ষেত্রে পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা গভীর সংকটে নিমজ্জিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারীদের অর্থনৈতিক অধিকার একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে আছে। পার্বত্য অঞ্চলে গড়ে উঠেনি কোন মিল, কারখান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কেবলমাত্র কাঠ,বাঁশ, মাছ, পাথর ও মৌসুমৗ ফল ক্রয় বিক্রয় ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ-পিসিজেএসএস-মুল উভয়ে উদাসীন। চুক্তির পর বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা-এনজিও সমূহ পার্বত্য অঞ্চলে তাদের সুদের ব্যবসা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে। প্রতিনিয়ত গরীব থেকে আরো গরীব হয়ে পরেছে এই অঞ্চলের খেটে খাওয়া নাগরিকরা। তার উপর রয়েছে চাঁদাবাজদের উপদ্রব।
পার্বত্য চুক্তিকালিন পাহাড়ে ছিলো ১টি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। চুক্তির পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আরো ৩টি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। পাহাড়ে এখন ৪টি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। কোন সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কাজ করলে ঐ কাজের ঠিকাদারকে দিতে হয় ৬% করে চাঁদা, অফিস খরচ ৩৭%, ৬% করে ৪টি আঞ্চলিক দলকে = ২৪%+ ৩৭% = ৬১%। ১শত টাকার মধ্যে ৪ আঞ্চলিক দলকে ২৪ টাকা আর অফিসকে ৩৭ টাকা মোট ৬১ টাকা। বাকি ৩৯ টাকায় কোটেশন প্রাপ্ত ঠিকাদারগণ কোন ধরনের গুণগত মানের উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করে থাকেন আশা করি বুঝতে কারো অসুবিধা হবে না।
কাপ্তাই হৃদে মৎস্য শিকারী, মৎস্য ব্যবসায়ী, বাঁশ ব্যবসায়ী, কাঠ ব্যবসায়ী, মৌসুমী ফল ব্যবসায়ী, নির্মান সামগ্রী ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, সাধারন ব্যবসায়ী, লঞ্চ, স্পিড বোট, কাঠ, হলুদ, আদা, মৌসুমী ফল, নির্মান সামগ্রী ও মৎস্য পরিবহনকারি ইঞ্জিন বোট, বাস, ট্রেক, সিএনজি অটো রিক্সা, মাইক্রো, চাঁদের গাড়ি (জিপ), মোটরসাইকেলসহ প্রতিটি যানবাহন, গবাদি পশু, শুকর,হাঁস, মুরগী, কৃষিপণ্য, জেলা শহর ব্যতিত প্রতিটি বাজারের দোকানদার, ব্যাংক, বিমা, সুদের কারবারি এনজিও, হোটেল-মোটেল এবং প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষকে চাঁদা দিয়ে জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
২০২১ সালের নভেম্বরে ১১ তারিখ এবারের ২য় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৫ নং বড় হরিণা ইউপিতে ভোটারগণ তাদের পছন্দের চেয়ারম্যান-মেম্বার প্রার্থী ভোট দিতে পারেনি। আঞ্চলিক দলের পছন্দের প্রার্থীর জিতিয়ে নিতে প্রতিটি কেন্দ্রের বুথে অস্ত্রধারীদের উপস্থিতি ছিল শতভাগ। ১টি স্বাধীন দেশে এঘটনায় ভোক্তভোগীরা স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি ক্ষুব্দ। যদিও তাদের প্রানের ভয়ে কোন অভিযোগ প্রকাশ করতে অপারগ।
আঞ্চলিক দল সমুহের যে কোন অনুষ্ঠানে পাহাড়ে বসবাসকারিদের গুনতে হয় বাড়তি চাঁদা। এসব আঞ্চলিক দল গুলো হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস-মুল),পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সংস্কারপন্থী (পিসিজেএসএস-এমএন লারমা), ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-মুল), ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গণতান্ত্রিক (ইউপিডিএফ-সংস্কাপন্থী)।
এছাড়া সরকারি বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের হুমকিতে তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় বসে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন না। এলজিইডি, পিডিবি, গণপুর্ত, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগ চাঁদাবাজদের কারণে ঠিক সময়ে উন্নয়ন কাজ শুরু এবং শেষ করতে পারছেন না। খোদ সরকার দলীয় সংসদ সদস্যর দাবি পাহাড়ে অবৈধ আস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর বিগত ২৪ বছরে পাহাড়ের জনগণ হারিয়েছে তাদের স্বতন্ত্রতা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও মৌলিক অধিকার। পাহাড়ের সাধারন জনগণ ক্রমেই জিম্মি হয়ে পড়েছে গোয়েন্দা সংস্থা, দল ও উপদলের কাছে।
অন্যদিকে মোবাইল নেটওর্য়াক, স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, উচ্চগতির ইন্টারনেট, পাহাড়ের প্রায় প্রতিটি সড়কে চেক পোষ্ট বসিয়ে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রন করছেন। পাহাড়ে সেনাবাহিনী থাকবে না একথা বলছি না, অবশ্যই পাহাড়ে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি। প্রয়োজন ছাড়া তাদের খেয়াল খুশি মত ১শত গজের ভিতর পর-পর চেকপোষ্ট বসিয়ে গণপরিবহনে তল্লাশী চালিয়ে সাধারন মানুষের চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি করায় জনসাধারন এটাকে হয়রানি বলে ধরে নেন।
গণমাধ্যমে পার্বত্য চুক্তির পক্ষে যাতে জনমত গড়ে না উঠে, পার্বত্য অঞ্চলের সাংবাদিকদের সমিতি,কমিটি,ক্লাব ও সংগঠন সমুহে বহিরাগত উগ্রসম্প্রদায় ব্যতিত স্থানীয় প্রগতিশীল কোন সাংবাদিক যেন সদস্য হতে না পারে তা ঠিক করে দেয় সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা।
গোয়েন্দা সংস্থা তাদের ইচ্ছা মতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবং পার্বত্য অঞ্চলের বাইরে রাজধানীসহ বিভিন্ন নামে অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু করে জামাত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের দিয়ে রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় করে পাহাড়ে বসবাসরত জনগণের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ বা টকশোর নামে পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে। কেউকেউ গোয়েন্দা সংস্থার সমর্থন নিয়ে এনজিও এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে বাঁধা সৃষ্টির পাঁয়তারা অব্যাহত রেখেছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিৎ।
এসব গোয়েন্দা সংস্থার ইচ্ছা বা মতের বাইরে পার্বত্য অঞ্চলের জনস্বার্থে কোন সংবাদ পরিবেশন বা প্রকশ করলে সেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তাদের চক্রের লোক দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বানোয়াট হয়রানি মুলক মামলা, পুলিশ এবং ক্ষমতাসীদের গুন্ডা-মাস্তান দিয়ে ঐ সাংবাদিকের বাড়ি-ঘরে গভীর রাতে হামলা-ভাংচুড় করে। পার্বত্য চুক্তি সমর্থনকারি পাহাড়ের গণমানুষের পক্ষে কথা বলায় এবং পাহাড় কেটে পরিবেশ ধ্বংসকারী সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় সৎ সেই সাংবাদিককে তার ২৫ মাসের শিশু-স্ত্রীসহ মিথ্যা মামলায় জেলখাটানো নজির মোটেও শুভ লক্ষণ নয়।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষারকালিন যারা পাহাড়ে কালো পতাকা উড়িয়ে ছিলো পার্বত্য চুক্তির বিরোধীতা করেছিল সেই সব জামায়ত-শিবির উগ্রবাদি ইসলামপন্থিদের নিয়ে সরকারের ১টি গোয়েন্দা সংস্থার দহরম মহরম কি প্রমান করে ? সেই সকল উগ্রমৌলবাদিদের দিয়ে পাহাড়ে বাঙ্গালীদের অধিকার আদায়ে জন্য নিত্য-নতুন সংগঠনের জন্ম দেয়া হচ্ছে তাদের কাজ, যাতে পাহাড়ে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের কোন সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করতে না পারে।
পার্বত্য অঞ্চলে কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থা সমুহের ভুমিকা অত্যন্ত রহস্যজনক!
এক সময় পার্বত্য অঞ্চলে কর্মরত সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই এর কর্মকর্তারা বলতেন, সরকার প্রয়োজন মনে করে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, তার ভাল-মন্দ এবং বাস্তবায়ন স্থায়ী রাজনৈতিক নেতা আর জনগণের করার ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন হলে অবশ্যই তাঁরা চুক্তির পক্ষে হয়ে সহায়তা করবেন। ২০০৭ সালের পর পাহাড়ে বসবাসরত স্থানীয়দের সাথে সেনাবাহিনীর সেই সর্ম্পক এখন আর নেই।
পার্বত্য চুক্তির পর পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীর নাগরিকরা আশায় বুক বেধেঁছিলো যে, পার্বত্য চুক্তি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত মানুষদের মুক্তির সনদ হিসেবে কাজ করবে কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সম্মানিত আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)র নিকট বিনয়ের সাথে প্রশ্ন রাখতে চাই “পার্বত্য চুক্তির সুবিধাভোগী কারা”?
পার্বত্য জেলা পরিষদ সমূহ অধিকতর শক্তিশালী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে ২৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। অন্তর্বতীকালীন গঠিত এ আঞ্চলিক পরিষদ চুক্তির পরবর্তী বছর দুয়েক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তদারকি ও সমন্বয় সাধনের কাজ করলেও বৈশি^ক মহামারী করোনা অতিমারী কালিন এবং বিগত বছরগুলিতে এ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং তার সদস্যরা পার্বত্য চুক্তি পরবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত অধিবাসীদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ তিন পার্বত্য জেলার সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে না।
রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠানে একটি সম্প্রদায় কেবল দায়িত্ব পালন করবে পার্বত্য অধিবাসীরা মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেন না। যারা রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্যের স্বীকার তাদের দ্বারায় স্বগোত্রের বা সম্প্রদায়ের জনসাধারন বৈষম্যে এবং নির্যাতনের শিকার। চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে উপস্থাপন করা হয়েছে, এ পরিষদ পৌরসভাসহ স্থানীয় পরিষদ সমূহ তত্বাবধান ও সমন্বয় করবে, তিন পার্বত্য জেলায় সাধারন প্রশাসন, আইন শৃংখলা উন্নয়নের ব্যাপারে আঞ্চলিক পরিষদ সমন্বয় সাধন ও তত্বাবধান করতে পারবে। আঞ্চলিক পরিষদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান কার্যক্রম পরিচালনাসহ এনজিওদের কার্যবলী সমন্বয় সাধন করতে পারবে। উপজাতীয় আইন ও সামাজিক বিচার আঞ্চলিক পরিষদের আওতাভুক্ত থাকবে। আঞ্চলিক পরিষদ ভারী শিল্পের লাইসেন্স প্রদান করতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পরিষদের সাধারন ও সার্বিক তত্বাবধানে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত সকল উন্নয়ন কার্যক্রম সমন্বয় সাধন করবে ইত্যাদি। এতকিছুর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সুবিধাভোগী কারা ২৪ বছরেও বিষয়টি পরিস্কার নয় পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের কাছে।
শরণার্থী বিষয়ক টাস্কর্ফোসের অফিস, জনবল ও অবকাঠামো চুক্তির ২৪ বছর পরেও দৃশ্যমান নয়। এই টাস্কর্ফোসের অধীনে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যতে অবস্থানরত শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনার পর শরণার্থীদের সর্বশেষ আবস্থান খুজে পাওয়া মুশকিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি কমিশন এর কার্যক্রম এখনো পর্যন্ত সভা আর সাংবাদিকদের স্বাক্ষাতকার প্রদান ছাড়া মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। অথচ এই কমিশনের চেয়ারম্যান একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির প্রতি তিন বছর অন্তর- অন্তর মেয়াদ বৃদ্ধি করে ব্যয়ভার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে করা হচ্ছে। তার সাথে সদস্য হিসাবে রয়েছেন তিন সার্কেল চীফ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ও রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানগণ। পার্বত্য চুক্তির মুল সমস্যা ভুমি সমস্যা। এই পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি কমিশন কি কাজ করেন পার্বত্য অধিবাসীদের কাছে আদৌ পরিস্কার নয়।
হতাশার কথা দুঃখজনক হলেও সত্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি কমিশন আজ পর্যন্ত একটি অভিযোগের ও নিষ্পত্তি করতে পারেনি। অথচ এই কমিশনের উপরে নির্ভর করছে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারীদের বাপ-দাদার সম্পদ ফিরে পাওয়ার রায়। কেন যেন মূলা ঝোলার মত ঝুলে আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি কমিশনের কার্যক্রম। এ ভুমি কমিশন আইন প্রবিধান আদৌ কি আলোর মূখ দেখবে পার্বত্যবাসীদের প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক। ভুমি কমিশনে যারা সদস্য বিশেষ করে সার্কেল চীফরা ভুমি সমস্যার সমাধানে সহায়তার পরিবর্তে এদের দ্বারাই প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে ভুমি নিয়ে জটিলতা। কারণ তারা কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেন না। এখানে চাকমা সার্কেল চীফের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো- রাঙামাটি সদরের ১০২ নং রাঙাপানি মৌজার সরকারী (১ নং) ভলিউম ও মাঠ খসরায় ৪১২ নং দাগের ভুমির পরিমাণ ৩ একর ৯০ শতক। দখলসূত্রে মালিক জনৈক আসমত আলী। কিন্তু ভোগ দখলকারী হিসেবে চাকমা সার্কেল চীফ জনৈক জীবণ চাকমা ও সেবিকা চাকমা নামে ৪৭ শতক জায়গা বন্দোবস্তী প্রদানের জন্য ৪ ফেব্রুয়ারী-২০১৩ সালে ১০২ নং রাঙাপানি মৌজার হেডম্যান হিসাবে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক বরাবর সুপারিশ প্রদান করেন। ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তির পরিবর্তে ভুমি বিরোধ প্রতিনিয়ত এভাবেই বেড়েই চলছে। রাঙামাটি টিভি উপকেন্দ্রের পিছনে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের ভবন নির্মানের জন্য সরকারীভাবে নির্ধারিত জায়গাতে শতশত অবৈধ দখলদার বাড়ীঘর নির্মান করে বসবাস করছে, ক্ষমতাসীন দলের একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে জাযগা কেনা বেচা অথচ সরকারী ভাবে খাস ভুমি ক্রয়-বিক্রয় নিষেধ, তার পরও অবাধে চলছে খাস ভুমি ক্রয়-বিক্রয়। পাহাড়ে প্রতিদিন গড়ে শত-শত অবৈধ স্থাপনা বন্ধ করার স্থানীয় প্রশাসনের উদ্দ্যোগ নাই।
রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ সমূহ আলাদা ভাবে প্রনয়ন করা স্থানীয় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে গঠনের আইন থাকলেও সরকার ভোটারদের মূল্যায়ন অগ্রাহ্য করে অন্তর্বতীকালীন পরিষদ গঠন করে রাজনৈতিক নেতাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এসব পরিষদ সমূহে সদস্যরা আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে যেমন খুশি তেমন করেই চালাচ্ছেন এসব জেলা পরিষদের কার্যক্রম। হাজারো প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত জেলা পরিষদগুলো পার্বত্য অধিবাসীদের কাছে নেই কোন জবাবদিহিতা। জেলা পরিষদগুলো যেন এনজিও সংস্থা। লেকচার পিকচার ভাউচার যেন তাদের দৈনন্দিন কাজ। সাধারন জনগণের কাছে বিতরণ করা খাদ্য শষ্য ও নগদ অর্থ বিতরণের মাষ্টার রোল এ সুবিধা ভোগীদের স্বাক্ষর অথবা মোবাইল নাম্বার পর্যন্ত ফাইলে খুঁজে পাওয়া যায় না। এসমস্ত জেলা পরিষদ সমূহ থেকে তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চাইলেও পাওয়া যায়না। দুর্নীতি-অনিয়ম কাকে বলে ? তা কত প্রকার এবং কি-কি শিখতে হলে বা দেখতে পার্বত্য জেলা পরিষদ সমুহ অন্যতম। কিন্তু অদ্যবধি এদের বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
তিন জেলার ২৬টি উপজেলার উপজেলা প্রশাসন কেবলমাত্র নিয়ম রক্ষার্থে সাধারন জনগণের সাথে সম্পৃক্ত। এসব উপজেলা পরিষদ কি কাজ করে জনসাধারন জানে না।
তিন পার্বত্য জেলার পৌরসভা ও তিন পার্বত্য জেলার ইউনিয়ন পরিষদগুলো এখন হয়ে উঠেছে ঠিকাদারদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। এদের সাধারন জনগণের সাথে যোগাযোগ নেই বললে চলে। দলীয় পরিচয় ছাড়া সাধারন জনগনের কদর এখন তাদের কাছে নেই।
পার্বত্য চুক্তির আলোকে যে সমস্ত বিভাগ পার্বত্য জেলা পরষদ সমূহে হস্তান্তরিত করা হয়েছে তন্মধ্যে -
১.কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
২.জেলা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ
৩.মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ
৪.তুলা উন্নয়ন বোর্ড
৫.জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ
৬.পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ
৭. প্রাণীসম্পদ বিভাগ
৮.মৎস্য বিভাগ
৯.বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প
১০.ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সাংস্কৃতি ইন্সটিটিউট
১১.জেলা শিল্পকলা একাডেমী
১২.বাজারফান্ড প্রশাসন
১৩.টেক্সটাইল ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট
১৪.জেলা সরকারী গণগ্রন্থাগার
১৫.যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর
১৬.স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর
১৭.আঞ্চলিক জনসংখ্যা প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট (আরপিটিআই)
১৮.জেলা সমাজসেবা বিভাগ
১৯.হর্টিকালচার সেন্টার
২০.জেলা সমবায় বিভাগ
২১. নার্সিং ট্রেনিং ইন্সটিটিউট
২২. স্বাস্থ্য বিভাগ
২৩. জুমচাষ
২৪. কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)
২৫. জেলা ক্রীড়া অফিস
২৬. পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতিত ইমপ্রুভমেন্ট ষ্ট্রাষ্ট ও অন্যান্য শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান
২৭. স্থানীয় শিল্প বানিজ্য লাইসেন্স
২৮. জন্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য পরিসংখ্যান
২৯. মহাজনি কারবার
৩০. স্থানীয় পর্যটন ইত্যাদি।
জেলা পরিষদ সমূহের কাছে হস্তান্তরিত এসব বিভাগ সমূহের কাজ কি ? প্রতিমাসে জেলা পরিষদ সমূহের সাথে মাসিক উন্নয়ন সভা-সমন্বয় সভা ব্যতিত হস্তান্তরিত বিভাগের বেতন ভাতা স্বাক্ষর করা ছাড়া উন্নয়ন বা অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। পার্বত্য চুক্তি করার পর থেকে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরী পাবে এমন আশা করেছিলো, সমতলে যেখানে তিন লক্ষ টাকা খরচ করে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রার্থী চাকরী পায়, সেখানে পার্বত্য অঞ্চলে জেলা পরিষদগুলোর মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরী পেতে গুনতে হয় আট থেকে দশ লক্ষ টাকা। পার্বত্য চুক্তির পর একটি বারের জন্য চুক্তি সম্পাদনকারী উভয়ে কেউ বলেনি যে, সরকারী চাকরী পেতে ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করা হোক। উল্টো চুক্তি সম্পাদনকারীদের দলীয় নেতাদের ঘুষ না দিলে মিলেনা চাকুরী। এখানে একটি কথা পরিষ্কারভাবে খোলাসা করা প্রয়োজন- পার্বত্য চুক্তির আলোকে স্থানীয় পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরী পাওয়ার কথা কিন্তু ঘুষ বাণিজ্য ও আমলাতন্ত্রের জটিলতার কারণে পার্বত্য অঞ্চলের বাহিরের লোকজন চাকরীর বাজার দখল করে আছে। যারা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষকে ভালোবাসেন তাদের মধ্যে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যতম।
বড়ই আশ্চার্যের বিষয় যারা বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন পার্বত্য চুক্তি বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে আবার চুক্তি স্বাক্ষরের দিন আসলে অর্থাৎ ২রা ডিসেম্বর আসলে জাক জমক পূর্ণভাবে দিনটিকে তারাই পালন করে। হাস্যকর হলেও অবিশ্বাস্য এদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে অথবা চুক্তির পক্ষে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের বাধ্যবাদকতা তাদের কাছে জিম্মি। এরা কারা? এরা কার স্বার্থে কাজ করে?
মূলতঃ ২০০৭ সালের পর থেকে পার্বত্য চুক্তি মুখ থুবরে পরেছে। সরকারের বাস্তবায়নকারীরা সরে গেছে তার মূল স্প্রিড থেকে। পার্বত্য চুক্তির বর্ষপূর্তি এলে চুক্তি স্বাক্ষরকারীর একটি পক্ষ তোড়ন নির্মান, সেই সব তোড়নে তাদের দলীয় নেতাদের বড়-বড় ছবি, সভা সমাবেশ, খেলাধুলা ও আনন্দ আয়োজন করে বিশালভাবে পার্বত্য চুক্তির বর্ষপূর্তি উদযাপন করেন।
১৯৯৮, ১৯৯৯,২০০০,২০০১,২০০২, ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫ ও ২০০৬ সালে রাঙামাটিতে পার্বত্য চুক্তির অনুষ্ঠান পালন করা হতো রাঙামাটি স্টেডিয়ামের মাঠে এবং রাঙামাটি জিমন্যাশিয়ামের মাঠে সে সময়ে কল্যাণপুরের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের বাসভবণ থেকে কয়েকশত পাহাড়ি-বাঙ্গালী যুবক মিলে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা করে শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রবোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) কে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে আসতেন।
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারি গেরিলা নেতা সন্তু লারমাকে এক নজর দেখার জন্য পাহাড়ি-বাঙ্গালীদের মধ্যে তখন যে প্রতিযোগিতা আর এ পাহাড়ের নেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালবাসা ছিল এখন তা অনেকটাই কমে গেছে এ গেরিলা নেতার জনপ্রিয়তা।
তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারি শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রবোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) সরকারকে দেয়া প্রতিশ্রুতিতে তিনি এখনো অনড়। তিনি যে তাঁর গেরিলা জীবণ ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে অস্ত্র জমা দিয়েছেন তা মি. লারমা রক্ষা করেছেন। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি যে শপথ বা উথ গ্রহন করেছেন তাও তিনি ২৪ বছর ধরে রক্ষা চলেছেন।
হয়তো ২শত বছর পর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে বিশ^বিদ্যালয় বা বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নিশ্চয় গবেষণা হবে তখন কিন্তু পাহাড়ের জনগণের স্বার্থে তাঁর পরিবার-পরিজনের ত্যাগ জুম্মজাতীয়তাবাদ সরকারকে দেয়া মি. লারমার প্রতিশ্রুতি ও শপথ রক্ষার কথা নিয়েও গবেষণা হবে। সেই সাথে যাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে পদে-পদে বাঁধা সৃষ্টি এবং কথা দিয়ে কথা রক্ষা না করা, যাকে রাজনৈতিক ভাষায় বলা হয় শুভঙ্করের ফাকি বা আমলাতন্ত্রের জটিলতা, নিশ্চয় ইতিহাসবিদ বা গবেষকরা তাদের বিষয়ে গবেষণা করে জানতে পারবেন। এ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ইউনেস্কো পুরুস্কার পেয়েছেন। একই কারণে মি. লারমা কেন আন্তর্জাতিক ইউনেস্কো পুরস্কার পায়নি তাও হয়তো একদিন গবেষকরা রহস্য উৎঘাটন করতে সক্ষম হবেন।
আগে পার্বত্য চুক্তির অনুষ্ঠান মানে হাজার-হাজার পাহাড়ি ও স্থানীয় বাঙ্গালীদের (চাকমা ভাষায় বলা হয় পুরান বাঙ্গাল) উপস্থিতি আর পাহাড়ি-বাঙ্গালীদের মিলন মেলা। সেই সময়ে পার্বত্য চুক্তির অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো রাঙামাটি স্টেডিয়াম মাঠে এবং জিমন্যাশিয়াম মাঠে আর এখন পার্বত্য চুক্তির সেই অনুষ্ঠান পালন করা হয় রাঙামাটি শিল্পকলা একাডেমীর হল রুমে বলতে গেলে আগেরও চেয়ে অনেকটাই সীমিত পরিসরে। এতে নিশ্চয় বুঝা যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বর্তমান অবস্থা এবং ক্ষমতাসীনদের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে অবস্থান।
এবার চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২ যুগ পুর্তির ডাক, জুম্ম জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করুন, পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জম্মু স্বার্থ পরিপন্থি সকল কার্যক্রম প্রতিরোধ করুন ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে শো-ডাউন করে পার্বত্য চুক্তির বর্ষপূর্তি উদযাপন করেন। পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরকারীর সরকার পক্ষ বলেন পার্বত্য চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে মি. সন্তু লারমা পক্ষ বলেন চুক্তির মূল ধারা সমূহ এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
পার্বত্য অঞ্চলের মুল সমস্যা হচ্ছে ভুমি সমস্যা যা আজ পর্যন্ত সমধান হয়নি এবং বর্তমান সরকারের নীতি নির্ধারকদের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে মনোভাব, দৃষ্টি পরিবর্তন না হলে পার্বত্য অঞ্চলের ভুমি সমস্যা সমধান হওয়ার সম্ভবনা নাই।
পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ করে এবং সকল সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান বা প্রশাসনকে সমভাবে মর্যাদা দিয়ে ১৯০০ সালের রেগুলেশন আইন, বাজারফান্ড আইন সম্পুর্ণভাবে বাতিল করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণমূল্যোয়ন এখন প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বা সময়ের দাবি। একই সাথে পার্বত্য অঞ্চলে দুইটি আইন চলতে পারে না। যে কোন একটি আইন দ্বারা পাহাড়ের জনসাধারনকে শাসন করা হোক। দেশে প্রচলিত অনেক আইনের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু পার্বত্য অঞ্চলে পার্বত্য চুক্তির দোহাই দিয়ে জনসাধারনকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, এক দেশে দুই আইন স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপন্থি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ শুভঙ্করের ফাকি আর ঘুম পাড়ানি মাসি পিসির গল্প শুনে দিন পার করতে রাজী নয়। পার্বত্য অঞ্চলের বিশেষ করে প্রত্যান্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা না পারে সইতে না পারে কইতে এমন একটা জীবণ যাপন করছে তাদের কথা যেমন গণমাধ্যমে আসেনা তেমনি মুখ খুললে পরের দিন লাশ পরে থাকে। জিম্মি দশায় রয়েছে পার্বত্য অঞ্চলের সাধারন খেটে খাওয়া অধিবাসীরা। মুক্তি চায় এবং শান্তিতে বাঁচতে চায় পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ।
বৃহস্পতিবার ২রা ডিসেম্বর ২০২১ সালে পার্বত্য চুক্তির ২৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই ২৪ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কি পেলেন আর কি হারালেন মূল্যায়ন করবেন পার্বত্য অঞ্চলের সাধারন জনগণ।
লেখক : নির্মল বড়ুয়া মিলন
সাংবাদিক ও মূখ্য সম্পাদক
সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম
৩০ নভেম্বর-২০২১ ইংরেজি
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।